শাহারিয়ার রহমান, ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহে কর্মরত সাংবাদিকরা এখন মিথ্য মামলা ও হামলায় বিপর্যস্ত। সরকারী দলের নেতাদের টেন্ডারবাজী ও নিয়োগ বানিজ্যসহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে লেখা-লেখী হলেই হামলা-মামলার শিকার হতে হয়। এছাড়া মোবাইলে হুমকী ধামকি ও গালিগালাজ তো সাংবাদিকদের নিত্য সঙ্গী।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ভাবে জেলার সাংবাদিকরা নাজেহাল হতে শুরু করেন। মারধর করার পাশাপাশি ভুয়া চাঁদাবাজী ও মানহানী মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানী করা হচ্ছে। এ পর্যন- জেলার অন-ত ১৩ জন সাংবাদিককে শারীরিক সহ বিভিন্ন ভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা মামলায় ঝুলছেন আরো ১৫ জন সাংবাদিক।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্যাডারদের হামলার শিকার হন দৈনিক নবচিত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং দৈনিক নয়াদিগন- ও দিগন- টিভির আলাউদ্দীন আজাদ। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তাকে ঝিনাইদহ শহরের হাটের রাস-ায় বেধড়ক পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এ সময় জেলার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকও নাজেহাল হন।
টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের জেলা প্রতিনিধি আসিফ ইকবাল মাখন শহরের পোষ্ট অফিস মোড়ে সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার শিকার হন। পুলিশের সামনে তাকে রক্তাক্ত জখম করা হয়। তিনি সন্ত্রাসীদের ভয়ে মামলা করার সাহস পান নি।
ঝিনাইদহ উপজেলা পরিষদের পল্লী ভবনে নাজেহাল হন জেলার সিনিয়র সাংবাদিক এনটিভি ও যুগান-রের স্টাফ রিপোর্টার মিজানুর রহমান ও এটিএন বাংলা এটিএন নিউজের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি নিজাম জোয়ারদার বাবলু।
দেশ টেলিভিশন ও ভোরের কাগজের আব্দুর রহমান মিল্টনকে শামিমা ক্লিনিকের সামনে আওয়ামীলীগের ক্যাডাররা মারধর করে।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার শৈলকুপা প্রতিনিধি সোহাগ কুমার বিশ্বাসকে শৈলকুপায় মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি শৈলকুপা ছেড়ে চট্রগাম ব্যুরোতে চাকরী নিয়েছেন। নিরবাংলা পত্রিকার মহেশপুর প্রতিনিধি নুর হোসেনেকে পেটানো হয় মহেশপুরে।
দৈনিক গ্রামের কাগজের রাজিব হাসানকে প্রেসক্লাব থেকে ডেকে নিয়ে লাঞ্চিত করা হয়। রাজিবকে মারার পর অনেক সাংবাদিককে হুমকী দিয়ে বলা হয় বেশি বাবা-বাড়ি করলে পরিণতি হবে রাজিবের মতো।
দৈনিক নয়াদিগনে-র হরিনাকুণ্ডু প্রতিনিধি মাহবুব মোর্শেদ শাহিন ও দৈনিক ইনকিলাবের হরিনাকুণ্ডু সংবাদদাতা নাজমুল আহসানকে হরিনাকুণ্ডু শহরে পুলিশের সামনে সেখানকার হাতুড়ী বাহিনী খ্যাত সন্ত্রাসীরা মারধর করে। এখনো হরিনাকুণ্ডু শহরে প্রকাশ্যে কোন সাংবাদিক চলাফেরা করতে সাহস না।
দৈনিক আজকালের খবরের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম রবি ও দৈনিক সংগ্রামের মখলেছুর রহমান লাড্ডু ভয়ে হরিনাকুণ্ডু উপজেলা মোড়ে আসেন না। এমন কি লাড্ডুর কাছে চাঁদা পর্যন- দাবী করা হয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার ঝিনাইদহ প্রতিনিধি আরিফুল আবেদীন টিটোকে ক’দিন আগে শহরের অগ্রনী চত্বরে পেটানো হয়। যার কারনে তাকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে হয়। নিউজ হবে না এমন মুচলেকা দিয়ে সাংবাদিকরা টিটোকে ছাড়িয়ে আনেন। এ বিষয়ে কোন নিউজ না হওয়ায় আশপাশ জেলার সাংবাদিকরা ঝিনাইদহের সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনে ধিক্কার জানান।
মহেশপুরের যায়যায়দিন পত্রিকার প্রতিনিধি নাসির উদ্দীনকে স’ানীয় এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চলের লোক নিয়োগ বানিজ্যের খবর পত্রিকায় প্রকাশের দায়ে মহেশপুরে এমপির ক্যাডাররা মেরে হাত ভেঙ্গে দেয়। এমপি চঞ্চল খালিশপুর বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কলেজে লোক নিয়োগের নামে ৮০ লাখ টাকা বানিজ্য করেন এবং ওই কলেজে তার আত্মীয় স্বজনকে চাকরী দেন বলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বলা হয়।
গত সপ্তায় এমপি চঞ্চলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিদিনে খবর প্রকাশিত হলে সাংবাদিক শেখ রুহুলকে মোবাইলে হত্যার হুমকী দেওয়া হয়। এভাবে দৈনিক অর্থনীতির সাজ্জাদ আহম্মেদসহ অনেক সাংবাদিক লাঞ্চিত হয়েছেন এ সরকারের ৩ বছরে।
সর্বশেষ দৈনিক নবচিত্রের মহেশপুর প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম পত্রিকায় সংবাদ পাঠিয়ে বের হবার সময় মহেশপুর থানার সামনে তাকে মেরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় তার মামলা পর্যন- মহেশপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন গ্রহন করেননি। মারধর করার সময় পুলিশ ঘটনাস’লে উপসি’ত থাকলেও ক্যাডারদের ভয়ে তারাও ঢুকে পড়েন থানার মধ্যে। আহত শহিদুলের অবস’া এখনো খারাপ। মারধরের পর এমপি চঞ্চল সাংবাদিক শহিদুলকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে দেখতে এসে ১০ হাজার টাকা দেন ।
জানা গেছে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় শুধু মাত্র দৈনিক নবচিত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং দৈনিক নয়াদিগন- ও দিগন- টিভির আলাউদ্দীন আজাদের উপর হামলার পর সাংবাদিকরা জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সামনে মানববন্ধন কর্মসুচি পালন করেন। বাকীদের মারধর করার পর কোন প্রতিবাদ বা নিজ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের সাহস পায়নি।
এছাড়া প্রমানহীন মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক জেলা প্রতিনিধি ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের আসিফ ইকবাল কাজল, দৈনিক সমকালের মাহমুদ হাসান টিপু, দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার আরিফুল আবেদীন টিটো, দৈনিক সংগ্রামের হরিনাকুণ্ডু সংবাদদাতা মোখলেছুর রহমান লাড্ডু, বাংলাভিশনের আসিফ ইকবাল মাখন ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের শেখ রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে।
সবচে মজার ব্যাপার অভিযুক্ত নিউজ বা ঘটনার সঙ্গে কোন ধরণের সমপৃক্ততা না থাকার পরও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানী মুলক মিথ্যা মামলা হচ্ছে। সাংবাদিক কাজল ও টিটোর বিরুদ্ধে এক ভুইফোড় ও বিতর্কিত এনজিও মালিককে দিয়ে মিথ্যা মামলা সজানো হয়।
গত বছর আদালতে মামলাটি অসাড় প্রমানিত হয়েছে। আমারদেশ পত্রিকায় পরিবহন শ্রমিকদের চাঁদাবাজীর নিউজ প্রকাশিত হলে সাংবাদিক টিটোর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। সেটিও মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে।
সমকালের মাহমুদ হাসান টিপু দৈনিক নবচিত্রের কেউ না হলেও তার বিরুদ্ধে মানহানি ও চাঁদাবাজী মামলা হয়েছে। দৈনিক রানার পত্রিকায় মাদক দ্রব্যের উপর তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তৎকালীন জেলা প্রতিনিধি কাজলের নামে মামলা করা হয়। অথচ ওই নিউজের সঙ্গে কাজল কোন ভাবেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন না এবং সে সময় তিনি বিটিভির ট্রেনিংয়ে হোটেল শেরাটনে ছিলেন।
অন্যদিকে মানহানী মামলা হয় দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান, দৈনিক নবচিত্রের প্রধান সম্পাদক আলহাজ্ব শহিদুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আলাউদ্দীন আজাদ, সম্পাদক অশোক কুমার, দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, স্টাফ রিপোর্টার কাজল চৌধূরী, সমকালের মাহমুদ হাসান টিপু ও গ্রামের কাগজের মিঠু শিকদারসহ অনেকের নামে।
জানা গেছে, এ সব হামলা মামলার পেছনে সাংবাদিকদের বিভেদ ও অনৈক্য প্রধানতম কারণ। ফলে জেলার সাংবাদিকরা অহরহ নাজেহাল হলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। বিষয়টি নিয়ে জেলার সিনিয়র সাংবাদিকদেরও কোন উচ্চবাচ্য নেই বলে মনে হয়।