ডেস্ক রিপোর্ট:: রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৪৯ জন। কিন্তু এর মধ্যে অধিকাংশই ভিন্ন পেশার মানুষ। প্রকৃত জেলেরা নিবন্ধন তালিকায় না থাকায় তারা সরকারি বিভিন্ন সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা বিতরণ নিয়েও নানান অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২/৩ পুরুষ ধরে জেলে, নদীতে মাছ শিকার ছাড়া যাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই, সেসব প্রকৃত জেলেরাই সরকারি তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারেননি। নিবন্ধন না থাকায় তারা কোনো খাদ্য সহায়তাও পান না।
অথচ জীবনে কখনো মাছ শিকার করেননি, প্রধান পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য বা কৃষি অথবা রিকশাচালক তারাই নিবন্ধিত জেলে। আছে জেলে কার্ডও। কার্ডের কারণে প্রতি বছর জেলে হিসেবে পান খাদ্য সহায়তা। আবার কার্ডধারী হলেও জনপ্রতিনিধিদের সন্তুষ্টি করতে না পারলে তাদের নাম খাদ্য সহায়তার তালিকায় থেকে বাদ পড়ে যায়। ফলে পেটের দায়ে মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে নদীতে নেমে আটক হয়ে হারিয়ে ফেলেন আয়ের একমাত্র সম্বল জাল ও নৌকা।
গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নে মোট জেলের সংখ্যা ৫০৫ জন ও দেবগ্রাম ইউনিয়নে জেলের সংখ্যা ৫১৮ জন। দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের জেলেদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা জেলে কার্ডধারী। জেলেদের তথ্য মতে তালিকায় ভুয়া জেলে রয়েছে দুই তৃতীয়াংশ। তবে উপজেলা মৎস্য অফিস দাবি করেছে, জেলেদের তালিকা করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তবে সেই তালিকা হালনাগাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। নতুন তালিকায় শত ভাগ জেলে স্থান পাবে।
সরেজমিন দেবগ্রাম ইউনিয়নের কাউয়ালজানি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নেদু শেখ নামের এক ব্যক্তি ও তার ছেলে দোলো শেখ, দুই জনই তালিকাভূক্ত জেলে। অথচ তারা কেউই পেশাদার মৎস্যজীবী না। আলাপকালে তারা জানান, পদ্মায় ইলিশ রক্ষা অভিযান কালে তারা একবার ২০ কেজি ও দ্বিতীয়বার ৮০ কেজি খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল পেয়েছেন। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী দুই বারে ১৬০ কেজি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও পেয়েছেন ১০০ কেজি।
একই এলাকার তালিকাভূক্ত অপর জেলে আব্দুল জব্বার। তার বাড়িতে গেলে দেখা যায় তিনি বাড়িতে নেই। এসময় তার স্ত্রী আয়শা বেগম জানান, তার স্বামীর এখন বয়স হয়েছে, তেমন কিছুই করেন না। তবে বাড়িতে টুকটাক কৃষি কাজ করেন। তিনিও ২ বারে ১০০ কেজি চাল পেয়েছেন।
পদ্মা নদীতে মাছ শিকাররত অবস্থায় কথা হয় দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের শামীম মন্ডলের সঙ্গে। তিনি জানান, তারা কয়েক পুরুষ পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু তার নিজের অথবা পরিবারের কারোই জেলে কার্ড নেই। তারা কোনো সহায়তাও পান না। জেলে তালিকায় নাম উঠাতে হলে চেয়ারম্যান- মেম্বারদের কাছের লোক হতে হয়, তা নাহলে জেলে কার্ড মেলে না বলে তিনি জানান।
এসময় স্থানীয় ছাড়াও পাবনা, মানিকগঞ্জের একাধিক জেলে অভিযোগ করেন, তারা সারা বছর নদীতেই থাকেন। কখন কে তালিকা করে, তাও তারা টেরও পান না। তালিকায় নাম উঠাতে তারা তদবীরও করতে পারেন না, তাই তারা জেলে তালিকার বাইরেই থাকেন। তারা আরও জানান, ভুয়া জেলেদের কারণে খাদ্য সহায়তা বিতরণের সময় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন জনপ্রতিনিধিরা। তারা টাকা ছাড়া তালিকায় নাম ওঠায় না। প্রকৃত জেলেরা টাকা দিতে অপারগতা জানায়, আর এ সুযোগে ভুয়া জেলেরা তালিকাভূক্ত হয়ে যায়।
দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাফিজুল ইসলাম জেলে তালিকায় অন্য পেশার লোক থাকার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, পূর্বের চেয়ারম্যান এই তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, সেখানে কিছু অসংগতি আছে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে নতুন তালিকা করা হবে। সেখানে প্রকৃত জেলেদের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হবে। আর খাদ্য সহায়তার বিষয়ে বলেন, তালিকাভূক্ত জেলের পরিমানের চেয়ে খাদ্য সহায়তা কম বরাদ্দ হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তালিকাভূক্ত সকল জেলেকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান মন্ডল জানান, বর্তমানে জেলেদের যে তালিকা তা দীর্ঘ দিন আগে প্রস্তুত করা। এর মধ্যে অনেকেই হয়ত ওই সময় মৎস্যজীবী ছিল, এখন পেশার পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু তালিকায় নাম থাকায় তারাও সুবিধা পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে ৯৫০ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি অনুমোদন হলে আশা করি কোনো প্রকৃত জেলেই তালিকার বাইরে থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘জাল যার তিনিই প্রকৃত জেলে। এর বাইরে কারো জেলে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মৎস্য বিভাগের সঙ্গে আলাপ করে প্রকৃত জেলেদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এবং অন্য পেশার কেউ থাকলে তাদের বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেব।’