চাল চোর তুই রাজাকার
জুনাইদ আল হাবিব

 

জুনাইদ আল হাবিব : কুদ্দুছ মিয়া (ছদ্মনাম)। বয়স ৬৫তে ছুঁয়েছে। পেশায় দিনমজুর। দিন এনে দিন খায়। বাড়ির ঠিকানা পেরিয়ে কুদ্দুছ মিয়াকে ছুটতে হয়। রোজ দুই-আড়াই’শ যা কামাই হয়, সব সংসারের পেছনে চলে যায়। বিবি-বাচ্চাদের নিয়ে জীবন চলছেতো চলছেই। কুদ্দুছ মিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে প্যাড়া নাই কোন। মাছে-ভাতে দু’মুঠো ভাত জোগাড়ের চেষ্টায় কেটে যায় তার দিনের পর দিন। হঠাৎ একটা সময় এসে কুদ্দুছ মিয়া আর বাজারে, রাস্তা-ঘাটে উঠতে পারে না। পুলিশ দৌঁড়ায়, পুলিশের লাঠিপেটার ভয়ে এক পা এগোলে দু’পা পেছায় সে। কুদ্দুছ মিয়া খোঁজ নেয়, পুলিশ দৌঁড়ায় কেন? জানতে পারেন, দ্যাশে করোনা আইছে।

করোনা কি সে এখনো বুঝে না। একটা পর্যায়ে জানাজানিতে জানতে পারেন, করোনা একটা ভাইরাস, রোগের মতো। এটাতে কেউ আক্রান্ত হলে সে মারা যেতে পারে। তাকে কেউ ছুঁতেও পারবে না। যে ছুঁবে সেও আক্রান্ত হবে৷ সবই বুঝলো কুদ্দুছ মিয়া। কিন্তু পেট চলে না আগের মতো। সময় যতো গড়ায়, তার মুখটা তত মলিন রূপ ধারণ করে। নিজে না খেয়েও দিনটা চালিয়ে নেয়। কিন্তু সংসার যে বড় টানাটানি। আদরের ছেলে-মেয়েরা যে না খেয়ে থাকছে। কুদ্দুছ মিয়ার আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু কোথাও থেকে কেউ এগিয়ে আসে না। পেটের ক্ষুধায় সন্তানরা কাতরাচ্ছে, অন্যদিকে নিজের পেটে বেঁধে রেখেছেন পাথর। লোকলজ্জার ভয়ে কারো কাছে কিছু চাইতেও পারছে না।

কুদ্দুছ মিয়া এবার তাকিয়ে আছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারের দিকে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। এবার নিজেই চলে যান ইউনিয়ন পরিষদে। কথা বলেন, মেম্বারের সাথে। মেম্বার কুদ্দুছ মিয়াকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মেম্বারের মতিগতি কুদ্দুছ মিয়া বুঝতে পারে। হতাশ হয়ে তিনি ফিরে আসেন বাড়িতে৷ কুদ্দুছ মিয়ার অবস্থা, পরিবারের অবস্থা জানতে পারে এলাকার এক মানবিক তরুণ হান্নান। হান্নান বিত্তবানদের থেকে কিছু সাহায্য সংগ্রহ করে গ্রামের এমন চার’শ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন খাদ্য সামগ্রী। ছবিও তোলেননি। ক্ষুধায় কাতর পরিবারগুলো হান্নানের এমন কর্মকে বাহ বাহ দিচ্ছেন।

কুদ্দুছ মিয়ার পরিবার চলে স্বেচ্ছাসেবক হান্নানের উদ্যোগের খাবারে। কুদ্দুছ মিয়া হঠাৎ খবর পান, চাল চুরির অপরাধে তার মেম্বারকে হাতে নাতে ধরে ফেলেছে গোয়েন্দা সংস্থার লোক। তথ্য বেরিয়ে আসে একের পর এক। স্থানীয় মেম্বার সরকারের দেয়া ২টন চাল আত্মসাৎ করেছেন। তার এ কৃতকর্মে এলাকার মানুষের কানে কানে খবর পৌঁছে গেছে। গ্রামের একজনের কানে কোন কিছু পৌঁছলেতো সেটা সবার কানেই পৌঁছে যায়৷ তদন্ত হয়, মেম্বার দোষী সাবস্ত হয়। জেলে আটক আছে এখন।

অন্যদিকে কুদ্দুছ মিয়া খোঁজ নিয়ে জানেন, রতন নামের একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের মাঝে বিনামূল্যে চাল, ডাল, আলু, মশলাসহ অন্যান্য তরিতরকারি বিতরণ করছেন। যার যেটা লাগে, সে সেটা নিয়ে যাচ্ছেন। কুদ্দুছ মিয়া শুনে ওই চেয়ারম্যানের প্রতি দোয়া করেন। অন্যদিকে, ওই মেম্বারের নাম মুখে আনতেও ঘৃনা হয় তার। গ্রামের যারা এমন কষ্টে ভুগছেন, তাদেরকে খবর দেন তিনি। তারাও চেয়ারম্যান রতনের বিনে পয়সার দোকান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক চাল-ডাল নিয়ে আসছেন। ওদিকে রতনের এ কাজ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে৷

অন্যগ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা কুলছুমা বেগম(ছদ্মনাম)। কুলছুমা বেগম ৫হাজার টাকা দিয়ে স্থানীয় মেম্বারের কাছে একটা চালের নাম বসিয়েছে। সে চালের জন্য দুপুরের তপ্ত রোদে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের দিকে ছুটছেন। কোথায় যাচ্ছেন? একজন জানতে চাইলে কুলছুমার উত্তর, চালের জন্য যাই, বোড অফিসে(ইউনিয়ন পরিষদ)। ৫হাজার টিয়া দি নাম বসাইছি, কেউ এমনি এমনি নাম দেয় নাই।

ওই গ্রামেরই মধ্যবিত্ত আলী হোসেন। রোজ যা আয় করেন, তা দিয়ে তারও সংসার চলতো। কিন্তু করোনার এ গৃহবন্দীতে তার আর সংসার চলে না। লজ্জায় হাত পাতে না কারও কাছে। দোকানের স’মিল ছিল তার। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়া রোজগারের খাতা শূন্য আলী হোসেনের। পাশের বাড়ির যুবক মহিন জানতে পারেন আলী হোসেনের সংসারের দুর্দশা। স্থানীয় সমিতির উদ্যোগে কিছু খাদ্য আসে মহিনের কাছে। মহিন তার মায়ের মাধ্যমে আলী হোসেনের ঘরে পৌঁছে দেন খাবার। এ খাবার পেয়ে আলী হোসেনের চোখে জল খুশিতে।

গ্রামেরই ২০ বছরের তরুণ সমাজ ভাবুক জুলহা। সমাজ নিয়ে ভাবনায় দেখতে পায়, প্রতিদিন দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। দেশে এখন শত শত মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন জীবনের সঙ্গে লড়াই করে। করোনাকালে কঠিন এ পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা যেন এক একজন করোনা যোদ্ধা। আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা করতে গিয়ে কয়েকজন চিকিৎসক এরই মধ্যে এ ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত।

তবুও ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার জনপ্রতিনিধিকের কেউ কেউ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, সাংবাদিক সবাই রীতিমত কাজ করে যাচ্ছে মানুষকে করোনা থেকে বাঁচাতে। ঠিক এই সময়ে জুলহা শুনতে পায়, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর চেয়ে চাল চোর ধরা পড়েছে বেশি। যারা এমন কঠিন যুদ্ধে মানুষের পাশে বিভিন্নভাবে দাঁড়াচ্ছে, তাদেরকে জুলহা স্বীকৃতি দেয় করোনা যোদ্ধা হিসেবে। আর যারা এ মুহুর্তে চাল চুরি করে মানুষের অধিকার হরণ করছে, তাদেরকে জুলহা রাজাকার বলছে। ধিক্কার দিয়ে বলে, শালা চাল চোর তুই রাজাকার!

 

 

 

 

লেখক: শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, অনার্স প্রথম বর্ষ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ। 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here