জুঁই জেসমিন

 

জুঁই জেসমিন :: কাল বাদে পরশু ঈদ- রাবির মায়ের দু চোখ খুশিতে চিকচিক করছে! গরু মাংসের এতো দাম যে, বহুদিন ধরে একটুকরো মুখে পড়েনি! রাবির বাবা ও তার ভাই রাফু, ঈদের হাট করতে যাবে বলে রাবি সওদার লিস্ট করে। অসুস্থ মা ঘর থেকে উকি মেরে টানা গলায় বলে “ও রাবি, পেয়াজ, আদা রসুন, মসলা-লিখে দিস মা, পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজন তো মাংস দিয়ে যাবেই।” রাবি সওদার লিস্টে দরকারি সব লেখে,তা ভাইয়ের হাতে দেয়। মায়ের ওষুধ পথ্য কিনতে প্রতি মাসে যা টাকা যায়, তাতে ভাল মন্দ কিছু কিনা বা খাওয়া হয়না অনেকদিন যাবৎ! বাড়িতে দু’টো মোরগ ছিল সেই মোরগ বিক্রি করেই আজকের বাজারটা চলবে। ক্রমশ রাফু ও তার বাবা মোরগ বিক্রি করে ওষুধপাতি সহ টুকিটাকি বাজার করে ঘরে ফিরে।

পরদিন মা রাবিকে বলে, মাংস রান্নার জন্য যাতে মসলা টসলা আগেই সুন্দর ভাবে বাটে রাখে। রাবি, মায়ের কথামতো সব ঠিক ঠাক করে রাখে। ঘরে ঘরে মহা আনন্দ, ঈদ আনন্দ। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা ফটকা ফুটায়, খুশির উল্লাসে। আকাশে বাতাসে আনন্দ ফুলকি ঝরে। দলে দলে চেনামুখ ঈদগাহে যায়, সবার চোখে মুখে কি অরূপ হাসি,আতর গোলাপ সুরমা আর নতুন পোষাকে সুষমাময় এক সকাল। রাবির হাতে বানানো জায়নামাজ কাঁধে চেপে রাফু ও তার বাবা ঈদগাহ যায়। রাবি রুটি বানানো শুরু করে, ভাই ও বাবা ঘরে ফিরলেই রুটি সেমাই খেতে দেবে।সেই সাথে ভাত ও সবজিও রেঁধে ফেলে রাবি। রাবি জানে, রাফুটা মোটেও রুটি পছন্দ করেনা,উৎসব গুলোতে নামে মাত্র মুখে দেয়। আর বাবার অভ্যাস হলো যতই এটাসেটা খাওয়া যাকনা কেন, ভাত তার লাগবেই। ঈদের নামাজ আদায় করে রাফুরা বাড়ি ফিরে। রাফু, ভাত খেতে খেতে বলে বুবু আজ সবার ঘরে ঘরে মাংস রুটি,,, আমি কিন্তু রুটি খাবোনা, মাংস দিয়েই পেট ভরে ভাত খাবো। রাবি ভাবনা মুখে মলিন হেসে বলে, তা তো খাবিই,, কেন খাবিনা—-?
সুর্য্যের চিবুকে বিমূর্ত সুখের শিরোনাম স্বপ্ন সেতো সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বিকেল আসে স্নিগ্ধতায় – মা রাবিকে ডেকে বলে মাংসের জন্য পিয়াজ কেটে রাখতে। রাবি বুঝতে পারে মাকে খুব গরু মাংস খেতে ইচ্ছে করে। আর করবেনা বা কেন সেই কবে খেয়েছিল খালার বাড়িতে- একটার পর একটা বিপদ ঝামেলা লেগে থাকার জন্য ইচ্ছে থাকা সত্তেও বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি মাংস কেনার। রাবি মনস্থ করে কয়েক বাড়ি থেকে মাংস এলেই মায়ের জন্য রান্না করবে, মাকে ভাল ভাবে রুটি মাংস খাওয়ায়ে তারপর নিজেদের কথা ভাববে। রাবি বসে থাকে বারান্দায়,খুব ইচ্ছে করে একটু বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আরাম ঘুম দিতে।
কিন্তু কেউ যদি মাংস দিতে এসে ফিরে যায় এ ভেবে বাইরে বসে থাকে। এদিকে তার মা’ও কান পেতে থাকে কেউ আসছে নাকি মাংস দিতে। খালপাড়ার দিলবাহার, গান গাইতে গাইতে আসে রাবিদের বাড়ি মাংস দিতে। রাবির নিরব নিঝুম মন চঞ্চল হয়ে উঠে খুশিতে। এদিকে মা রাবিকে বার বার ডেকে বলে, ওমা কতটা মাংস দিয়ে গেল দিলবাহার, নিয়ে আয় দেখি, একটু দেখিরে মা, একটু দেখি! রাবি ঘরে এসে মাকে মাংসের টুকরো কয়েক দেখায়- তার মধ্যে দুটো অজংগা হাড়, আর একটুকরো জিহ্বার অংশ ও একটুকরো মাংস।
মায়ের মুখ খানা মুহূর্তের মধ্যে বিমর্ষ আঁধারে একাকার হয়ে যায়! রাবি বুঝতে পারে মায়ের মন ভাঙার অবস্থা, সে মা’কে সান্তনা দেওয়ার জন্য জোর করে হেসে বলে- ” ওমা আরো তো অনেকেই দিতে আসবে মাংস, মন খারাপ করোনা তো। পুরনো বাড়ি থেকে তো এখনো দেয়নি, এখনিই দিতে আসবে,,,,,দেখো।” সন্ধা ঘনিয়ে আসে- রাবির ভাবনাটা বেশ ভারী হতে থাকে, মাকে কি রান্না করে দেবে, কি বলবে? ঘোর ভাবনায় দিলবারের দেওয়া মাংস টুকরো অগণিত বার নাড়তে নাড়তে সারাদিনের ক্লান্তিতে টলে পড়ে রাবি।
হঠাৎ পুরনো বাড়ি থেকে মেঝো চাচার ডাক, ও রাবি,? রাবি— মাংস টা নেতো মা, বাড়িতে ছিলাম না তাই বেলাতে দিয়ে যেতে পারিনি। তোরা নতুন বাড়িতে আসার পর থেকে তেমন দেখা সাক্ষাত, কথা বলা হয়না । যাহোক মাংসটা নে। একটা মাত্র ভাগ, ছোটো গরু, বেশি মাংস হয়নি । তাই বেশি দিতে পারলাম না, মা। ” এ বলে চলে যায়। রাবি চাচার দেওয়া মাংস দেখে ভুপলে কেঁদে উঠে -! ” এ কয়েক টুকরো শুধু, আবার মাংস না, হাড়,,,! রাবিরা কারো কাছে হাত পাতার মতো গরীব না, যে হাত পেতে এক টুকরো মাংস চায়বে কারো কাছে। প্রতিবার কোরবানি দিতো কষ্ট শিষ্ট করে।
কিন্তু তার মায়ের অসুখে বেশ অর্থ গেল এবার, আবার পুরনো বাড়ি ভেঙে বাইরে এসে বাড়ি করতে হয়েছে, পুরনো ভিটে বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা ও নতুন বাড়ির কাজে ব্যয় করা হয়েছে। রাবি বিকেলে দেখেছে অনেক ভিক্ষুকের হাতে দুই হতে তিন কেজি মাংস, পলিথিন ব্যাগে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওরা তুলেছে। তাই তার মনে বড় অভিমান বার্তা, অভিযোগে তোলপাড় দেয়-” গরীবের গরীব যারা, তাদের ঘরেও আজ ঢের মাংস,আর আমাদের মতো মধ্য ঘরে-? মধ্য শ্রেণীর খবর বুঝি এ যুগে বিধাতাও রাখেনা-! রাফুটা পেট পুরে মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে,,, আর মা? মা যে চেয়ে আছে —এক টুকরো মাংস মুখে দেওয়ার আশায়!”
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here