তাহমিনা শিল্পী :: আজ পহেলা পৌষ, ১৪২২ বঙ্গাব্দ। ভোর ৬.২৫ মিনিটে কোন শাল, জ্যাকেট কিম্বা সোয়েটার ছাড়াই অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। একটু আশংকা হচ্ছিল এই ভেবে আবার না ঠান্ডা লেগে যায় কিন্তু বেরুতেই এমন এক হিমেল স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ পেলাম। আমার গান গাইতে ইচ্ছে করল- “বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে/সই গো বসন্ত বাতাসে”।
ছোট বেলায় যখন হাঁড় কাঁপুনি শীতে সবার একেবারে কাঁপাকাঁপি অবস্থা হয়ে যেত, তখন আমার নানু বলত- “পৌষের শীত মহিষের গায়ে, আর মাঘের শীত বাঘের গায়ে”। এটা বললে সব শীত বাঘ আর মহিষের গায়ে চলে যায় আর মানুষের তখন শীত কমে যায়। হয়তবা ওই সময়ে এই প্রবাদটি এতবার পড়েছি তাই এখন আর শীত লাগছে না। নাকি প্রকৃতিই আসলে ভুলে গেছে যে শীতকাল এসে গেছে! কিন্তু তাই বা বলি কি করে? ওদিকে তো আবার চরম শীতে কাঁপছে উত্তর বঙ্গ সহ দেশের নির্দষ্ট কিছু অঞ্চলের মানুষ।
জলবায়ুর পরিবর্তন আজ এক স্বীকৃত সত্য, বাস্তব ঘটনা। এর প্রভাবে বাড়ছে তাপমাত্রা, ঘটছে পৃথিবী নামের গ্রহটির উষ্ণায়ন৷ আর উষ্ণতা বাড়ার কারণে ঘটছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ এর ফলে এখানে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, বাড়ছে লবণাক্ততা৷ তবে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হল গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন এবং যে কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফলে বাংলাদেশের মতো দ্বীপরাষ্ট্রগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন-জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বাস্তুভিটা থেকে উদ্বাস্তু হচ্ছে। একটা সময় ছিলো যখন বাংলাদেশকে বলা হতো শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ইত্যাদি সবকিছুই ছিলো। কিন্তু বর্তমানে সময় পাল্টে গেছে। এখন নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে দিন বদলের জন্য টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
উদ্বেগজনক তথ্য এই যে, ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখন্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, প্রতিদিনই মানুষ নদী ভাঙ্গন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ শিকার হয়ে ঢাকায় এসে বস্তি গড়ছে। ঢাকার মানুষ এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এখানে বাস করেন ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ।
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। নদীতে নিজের চাষ করা জমি হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে নিজের বসতিটুকুও। সচ্ছল কৃষক পরিণত হয়েছে বেকারে। কাজ নেই, মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই, খাদ্য কেনার পয়সাও নেই। কোথাও নোনা পানির কারণে চাষাবাদ করা যায় না। মৎস্যজীবীদের কেউ কেউ এখন তাদের পূর্ব পেশা ছেড়ে ঢাকায় রিকশা চালায়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন- আগামীতে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।
বাংলাদেশের আশংকা, আগামী ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশটির বিরাট এলাকা ডুবে যাবে এবং দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সম্প্রতি বৃটিশ গণমাধ্যম প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ থেকে বাংলাদেশের বাঁচার একমাত্র পথ অভিবাসন। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটারেরও কম উচ্চতাসম্পন্ন এবং তা কোন না কোনভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত হুমকির মুখে রয়েছে।
প্রকৃতির এমন এক বিরূপ সময়ে প্রতি বছরের মতো এ বছরও ৩০ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ২১তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু কনভেনশনের সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সরকারি একটি দল, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বেশকিছু এনজিওর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। জলবায়ু সম্মেলন মূলত জলবায়ু কনভেনশনের ১৯৬টি সদস্য রাষ্ট্রের আলোচনা। এ সম্মেলন এককভাবে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির কোনো বিষয় হয়তবা নেই। তবুও এ সম্মেলনে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রই চেষ্টা করে তাদের নিজ নিজ স্বার্থসংরক্ষণের বিষয়ে সচেষ্ট থাকে। বাংলাদেশও নিশ্চই তার স্বার্থসংরক্ষণের বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ এবং সচেষ্ট ছিল কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসু হয়েছে বা হবে তা সময়ই বলে দিবে। অথবা এর ফলাফল বুঝতে পারাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশকে বিভিন্ন সমস্যার আবর্তে ফেলছে। তাই শুধু বিশ্ববাসীর দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবেনা। বরং সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যার মোকাবেলায় সচেষ্ট হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ ঝুঁকি মোকাবেলায় উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষার জন্য টেকসই বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ ও পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উপকূলীয় এলাকায় টেকসই আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।ভূমি ব্যবহারের সুষ্ঠু পরিল্পনার অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও পর্যন্ত অনেক কৃষি ও আবাদযোগ্য জমি অব্যবহৃত রয়ে গেছে।তাই কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার মাধ্যমেও জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা করা যেতে পারে।
তাছাড়া উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে সমস্যা সম্পর্কে জনগণ সতর্ক থাকবে। জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা আবশ্যক। বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।উন্নত বিশ্বের যে রাষ্ট্রগুলো এই সমস্যার জন্য দায়ী তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রাপ্তির জন্য সচেষ্ট হতে হবে এবং কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে সরকারের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সময়-কাল ও কর্মপন্থা নিয়ে দ্বিধান্বিত বিশ্ব নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের কাছ থেকে তার ভবিষ্যৎ বাঁচানোর সময়টুকু ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তাই শুধুমাত্র আলোচনা আর সম্মেলন এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সুদূর প্রসারী এবং দ্রুত সমাধানের উপায় বের করে তার যথাযথ প্রয়োগ করাই সরকারের কাছে এখন বাংলাদেশের অগনিত মানুষের দাবী ও প্রত্যাশা।
লেখকের ইমেইল: tahmina_shilpi@yahoo.com