গাস্সিঃ একটি হারিয়ে যাওয়া লোকজ উৎসব
–তাহমিনা শিল্পী
‘আশ্বিনে রান্দি কার্তিকে খাই,যেই বর মাঙ্গি সেই বর পাই’ – এটি সম্ভবত খনার বচন।অথবা,গ্রাম-বাংলায় বহুল প্রচলিত লোকছড়া।সে যাইহোক, এই ছড়াকে ঘিরে রয়েছে একটি লোকজ উৎসব অথবা একটি লোকজ উৎসবকে ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই ছড়াটি।যদিও সময়ের সাথে সাথে বর্তমানে উৎসবটি হারিয়ে গিয়েছে।তবুও বাঙালীর মনে এই উৎসবের স্মৃতি ভীষণই উজ্জ্বল।বাঙালী সংস্কৃতিতে এই উৎসবের বেশ গুরুত্ব রয়েছে।তাই আবার ফিরে পাবার সুপ্ত একটি বাসনায় প্রাচীন এই সংস্কৃতির সাথে আগামী প্রজন্মর পরিচয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে আজকের এই প্রতিবেদন।
বৃহত্তর ফরিদপুরে উৎসবটির আঞ্চলিক নাম গাস্সি।অঞ্চলভেদে এই উৎসবের নাম ও পালনের রীতিতে তারতম্য রয়েছে।একে কোথাও বলে ‘গারু সংক্রান্তি’ বা ‘গারু হারকাইন’। কোথাও আবার ‘গারু গোসল’ নামে পরিচিত।মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে বলে ‘গাড়ই’।
এই উৎসবে আশ্বিনে রেঁধে কার্তিকে খাওয়ার প্রচলন।আশ্বিনের শেষ দিন নানা পদের সবজি, ভাত ও খাবার রান্না করে রাখা হয়। খাওয়া হয় কার্তিকের প্রথম দিন সকালে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই খাবারে গৃহস্থের বা তার পরিবারের কল্যাণ হয়।
গাস্সি মূলত সনাতন ধর্মের পার্বণ। সনাতন ধর্মের মতে, স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনী কুমারদ্বয় সূর্যদেব ও সংজ্ঞার পুত্র। অভিশাপগ্রস্ত সংজ্ঞা জগজ্জননী পার্বতীর কাছে নিজের দুর্দশা থেকে মুক্তি চাইলে পার্বতী এক মুষ্টি চাল দিয়ে তাকে বলেছিলেন আশ্বিন মাসের শেষ তারিখ শেষ সময়ে রান্না করে কার্তিক মাসের ১ম দিবসে সেই অন্ন ভক্ষণ করলেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে। সে নিয়ম মেনে অভিশাপমুক্ত হয়েছিল সংজ্ঞা।সংজ্ঞার অভিশাপমুক্তির ধারাবাহিকতায় রোগ থেকে আরোগ্যলাভসহ ফসলেরও নিরাপত্তা চায় কৃষক। ফসলের বালা-মুসিবতসহ রোগবালাই থেকে আরোগ্য কামনায় ধীরেধীরে এটি একটি লোকজ উৎসব হয়ে ওঠে।
গ্রাম অঞ্চলে এই দিনে থাকে খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন।উৎসবের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই চলে প্রস্তুতি।বিভিন্ন ধরনের পিঠা,মোয়া বানান হয়।আঙিনাতে আঁকা হয় আলপনা।আশ্বিনের শেষ দিন ভাত ও নানান রকমের ভর্তা,মেথি শাক,উচ্ছে,নিরামিষ,ইলিশ,কৈ আর পুঁটি মাছ ভাঁজা,বেগুন ভাঁজা।কেউ কেউ চর্মরোগ থেকে সুরক্ষার জন্য আশ্বিনের রাতে নিমপাতার সঙ্গে হলুদ বেটে কার্তিকের ভোরে শরীরে মাখতেন। গৃহস্থ ঘরের বউয়েরা সকালে নদীতে গোসল করে পিতলের বদনা মেজে পানি ভর্তি বদনা দরজার সামনে রেখে দিতেন। বদনার পানিতে গুঁজে রাখতেন কচি পাতাসহ আমগাছের ডাল। লাঙল জোয়ালে ছিটাতেন সোনারুপোর পানি।সূর্যদেবের স্ত্রী সংজ্ঞা দেবীর সংজ্ঞায় না পড়লেও ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে কার্তিককে স্বাগত জানানোর জন্য আয়োজনে কোন কম ছিল না।
বড়দের পাশাপাশি এই উৎসবকে ঘিরে শিশুদের আনন্দ-আয়োজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।আশ্বিনের শেষ দিনে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে ২০-২৫ জন শিশু-কিশোরীদের প্রত্যেকেই আয়োজনে শরীক হয়।সবাই মিলে বেশ খেটেখুটে বাড়ীর উঠোনের কোণে পাটখড়ির খুটি দিয়ে, কলাপাতার ছাইনি দিয়ে ছোট ঘর তৈরী করে।খোলা আকাশের নিচে তৈরী করে মাটির চুলা। এরপর শুরু করে রান্নাকর্ম। কেউ বাটনা বাটে,কেউ কুটনো কাটে, কেউ পানি তুলে আনে,কেউ চাল-সবজি ধোয়, কেউ আবার চুলায় আগুন জ্বালায়।চড়ুইভাতির নিয়মে সমস্ত উপকরণ একসাথে জড়ো করে ছোট ছোট হাঁড়িতে রান্না করে ছোট ঘরে রেখে দেয়।রান্না শেষে নিমপাতা,বরইপাতা, কাঁচাহলুদ,মেথি বেটে কলার পাতায় আলাদা আলাদা করে কুলোর উপর রেখে দেয়।
সন্ধ্যা হলেই থালা,বাটি,গামলা,চামচ ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পরে।এবাড়ি-ওবাড়ির শিশুদের মধ্যে চলে গানের লড়াই।তারা বিভিন্ন লোক গানের মাধ্যমে লড়াই করে।কখনও আবার তাৎক্ষণিক গান রচনা করে,প্যারোডি সুরে গায়।এবং অন্যবাড়ীর শিশুদেরকে পরাজিত করে আনন্দ পায়।এই গানের যুদ্ধ চলতে থাকে সারা রাত ধরে।
পরদিন কার্তিকের প্রথমদিনের ভোর বেলায় আগেরদিন বেটে রাখা নিমপাতা,বরইপাতা,কাঁচাহলুদ ও মেথি গায়ে মেখে গোসল সেরে রান্না করে রাখা খাবার ছোট ঘরের পাশে পাটি পেতে বসে কলার পাতায় খাবার বেড়ে সবাই মিলে আনন্দ করে খায়।
আহা! সেই খাবারের কি যে স্বাদ! যে একবার খেয়েছে,সে কখনও ভুলতে পারবে না সেই অমৃতস্বাদ।