এস এম মাসুদ আলম, ঝিনাইগাতী (শেরপুর)

শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার গারোপাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা মূল্যের বৃক্ষ লুটপাট হচ্ছে। প্রতিকারের ব্যবস’া না থাকায় বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, সংঘবদ্ধ কাঠচোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা বন কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজসে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা মূল্যের বৃক্ষ লুটপাট করে আসছে। ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের তাওয়াকুচা, গজনী, হালচাটি, নওকুচি, বাকাকুড়া, গান্ধীগাঁও, গুরুচরণ দুধনই, সন্ধ্যাকুড়া ও রাংটিয়া এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে আকাশমনি ও শাল গজারীসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ লুটপাট করা হচ্ছে। স’ানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজেসে বনায়নের অংশীদার ও কাঠচোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা পাহাড় থেকে কাঠ কেঁটে প্রথমে ঘোড়ার গাড়ী, ভ্যান গাড়ী ও ট্রলী যোগে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে এনে স’প করে রাখা হয়। পরে সময় ও সুযোগ বুঝে এসব কাঠ যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক ও ট্রলিযোগে দেশের বিভিন্ন স’ানে পাচার করা হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই জেলা সদরসহ দেশের বিভিন্ন স’ানের ইট ভাটাগুলোতে জ্বালানী হিসেবে ব্যাপকভাবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব জ্বালানীর সিংহভাগ কাঠ সংগ্রহ করা হচ্ছে গারো পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে।

জানা গেছে, ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রায় শতাধিক কাঠ ব্যবসায়ী রয়েছে। এসব কাঠ ব্যবসায়ীরা কাঠ চোর সিন্ডিকেটের সদস্যদের অগ্রীম টাকা দিয়ে কাঠ চুরিতে উৎসাহিত করছে। এদের উৎসাহ ও অগ্রীম টাকা পেয়ে কাঠ চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা দিনে-রাতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলেছে। বর্তমানে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন হাট বাজারগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা মূল্যের চোরাই কাঠ অবাধে বেচা-কেনা হচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছে স’ানীয় বন কর্মকর্তা কর্মচারী ও স’ানীয় থানা পুলিশ । ব্যাবসায়ীরা জানান, পুলিশ ও বন বিভাগের নজরানার টাকা আদায়ের জন্য আলাদা আলাদাভাবে লোক নিয়োগ করা হয়েছে।

ফলে প্রকাশ্যে দিবালোকে এসব চোরাই কাঠ অবাধে বেচা-কেনা হলেও স’ানীয় প্রসাশনসহ বন বিভাগ দেখেও তা না দেখার ভান করছে। অনেক সময় বন কর্মকর্তা কর্মচারীরা চুরাই কাঠ প্রাচারের ব্যাপারে নিলামের কাঠ দেখিয়ে ব্যাবসায়ীদের ছাড়পত্র দিচ্ছে টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র দিচ্ছে। বন কর্মকর্তা কর্মচারীরা কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট হারে মাসোহারা আদায় করে আসছে। কাঠচোররা এখানে প্রায় প্রতিদিনই বৃক্ষ নিধন ও ট্রাক, ট্রলীসহ যাত্রীবাহী বাসে লাখ লাখ টাকা মূল্যের চোরাই কাঠ দেশের বিভিন্ন স’ানে পাচার করে আসছে। চোরাই কাঠ পাচারের সময় স’ানীয় লোকজন বন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অবহিত করেও কোন কাজ হচ্ছে না। কোন কোন সময় অবহিত করা হলে বন কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ঘটনাস’লে আসার আগে ফোনে ব্যবসায়ীদের চোরাই কাঠ সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেন। পরে গড়িমসি করে অবশেষে এক ঘন্টা পর ঘটনাস’লে আসেন। এসে ওইসব চোরাই কাঠ আর পান না বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন কর্মকর্তা কর্মচারীরা উল্টো অভিযোগকারীকেই শাসিয়ে যাচ্ছে অহরহ। মাঝে মধ্যে বন কর্মকর্তা কর্মচারীরা লোক দেখাতে চোরাইকাঠ আটক করে। কিন’ নিয়ম অনুযায়ী এসব কাঠ অফিসে নেয়ার কথা থাকলেও তা অফিসে না নিয়ে কোন কোন ব্যবসায়ীদের নামে জিম্মায় দেয়া হচ্ছে। পরে জিম্মায় রাখা আটককৃত কাঠ বন কর্মচারীরা অবৈধভাবে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বিপুল পরিমাণের অর্থ। আবার কোন কোন সময় অফিসে নেয়া হলেও রাতের অন্ধকাওে তা বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। উপজেলা সদরের কাঠ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী, ছামিউল হক, খলিলুর রহমান ও ওমর গাজীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১ ট্রলি কাঠ ১৫ হাজার টাকায় ক্রয় করে তা বিক্রি করছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায়। গত ১৯ অক্টোবর ঝিনাইগাতী উপজেলার ধানশাইল বাজারের ব্যবসায়ীরা পাচারের উদ্দেশ্যে ২টি ট্রাকে চোরাই কাঠ ভর্তি করার সময় স’ানীয় মাসুম নামের এক ব্যক্তি ঘটনাটি গজনী ফরেষ্ট বিট কর্মকর্তাকে অবগত করেন।

এসময় ওই বিট কর্মকর্তা চোরাই কাঠ আটক করতে প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে মাসুম বিষয়টি বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে চান। এসময় নিরূপায় হয়ে বিট কর্মকর্তা শাহিন শাহ-আলম চোরাই কাঠ আটক করতে ঘটনাস’লে যায়। অভিযোগ রয়েছে বিট কর্মকর্তা ঘটনাস’লে রওনা হওয়ার পূর্বেই চোরাই কাঠ ব্যবসায়ীদের কাঠ সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেন। পরে মাসুমসহ বিট কর্মকর্তা ঘটনাস’লে গিয়ে আর কাঠ পায়নি। গত ২৩ অক্টোবর রাতে চোরাই কাঠ ভর্তি ১টি ট্রাক পাচারের সময় স’ানীয় এক ব্যক্তি বনকর্মকর্তাকে অবহিত করেন। কিন’ স’ানীয় বন কর্মকর্তা ওই চোরাই কাঠ ভর্তি ট্রাক আটক না করলে পরে অভিযোগকারী শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক সাইফুল ইসলামকে জানায়, তিনি ঝিনাইগাতী থেকে কাঠ ভর্তি ট্রাকটি আটক করেন। অভিযোগ রয়েছে সহকারী বন সংরক্ষক আটককৃত কাঠগুলো অফিসে না নিয়ে স’ানীয় জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তির জিম্মায় রেখে যায়। পরে ওই কাঠগুলো গোপনে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে কাঠচোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা গারো পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতিদিন নির্বিচারে বৃক্ষনিধন কওে আসছে। রাংটিয়া গ্রামের যুগল কিশোর কোচ, নওকুচি গ্রামের ডাঃ গোলাপ হোসেন, ডেফলাই গ্রামের ডাঃ নবীজল হক রানা ও বাকাঁকুড়া গ্রামের আঃ রহিম, সরাফত আলী মাষ্টার ছোট গজনী গ্রামের ফিলিসন সাংমা, পানবর গ্রামের জুয়েল মিয়াসহ গ্রামবাসীরা জানান, বনায়নের অংশীদার ও কাঠ চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ কাঁটার পর গাছের গোড়া মাটি বা আর্বজনা দিয়ে ঢেকে রাখা হচ্ছে। আবার কোন কোন সময় নতুন কাঁটা গাছের গোড়ায় কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। যাতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্তে এলে গাছের গোড়া দেখে বুঝা না যায়, যে গাছ কাঁটা হয়েছে। এভাবেই বন কর্মকর্তা কর্মচারী ও কাঠচোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে চলেছে।

ফলে এক দিকে সরকার বিপল পরিমানের রাজস্ব হারাচ্ছে। অপর দিকে গারো পাহাড়ের বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা এবং উপজেলা বন ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল আলমের সাথে কথা হলে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন প্রতি মাসে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। এবং উক্ত সভায় বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে স’ানীয় রেঞ্জকর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। এছাড়া বৃক্ষনিধন রোধে বন কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস’া গ্রহণের জন্য নির্দেশও দেয়া হয়।ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন খানের সাথে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে বৃক্ষ লুটপাট রোধে তার আন্তরিকতার কোন অভাব নেই।

তবে যে সরিষা দিয়ে ভ’ত তারাবেন সে সরিষাতেই ভ’ত। এমন বিষয় নিয়ে তিনি চিন্তা যুক্ত।তিনি বলেন বনের তুলনায় আমাদের লোক বলের অভাব রয়েছে। এরপরেও আমরা আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি করছি না।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here