বোরহান উদ্দিন :: এই তো সেই দিন নিরাপদ সড়কের জন্য ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা রাজ পথে প্রতিবাদ করে ছিলো। কিন্তু তাতেও কি সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়েছে। না বন্ধ হয় নাই বরং প্রতিদিন সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না!
নিরাপদ সড়কের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ভুমিকা ছেড়ে আমাদের সচেতনতা সব চেয়ে বড় বিষয়। আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবর্তন না হলে অন্যের উপর দোস দিয়ে লাভ নাই। স্ট্র্যাটিজিক স্ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এস টি পি) কথা আপনাদের মনে আছে হয় তো। কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কি আজও হয়েছে? বলা চলে এটা পরিত্যক্ত অবস্থা রয়ে গেছে। আর এর সাথে পরিবহন শ্রমিকদের কথা একটু বলতে চাই।
ঢাকা রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ গণ পরিবহন বা পাবলিক বাসে উঠতে কত যুদ্ধ করতে হয় তা আমরা দেখি বা জানি। যেখানে এক জন সুস্থ মানুষ বাসে উঠতে এত কষ্ট সেখানে বিশেষ ভাবে সক্ষম (প্রতিবন্ধী ব্যক্তি) মানুষের কথা আমরা কত টা চিন্তা করি। তাই আজ আপনাদের সাথে এই বিষয় নিয়ে শেয়ার করবো।
সরকারি বাসে যাতায়াতের সময়ে নিজেদের অধিকার থেকে বহু ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন শারীরিক/দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। সরকারি বাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারছেন না। অথচ এটা তাঁদের আইনে স্বীকৃত অধিকার। আবার সরকার মনে করে, কোনও প্রতিবন্ধীর সঙ্গে ‘এসকর্ট’ বা সহায়ক থাকা জরুরি, তা হলে সেই সহায়কও বিনা টিকিটে যেতে পারবেন। কিন্তু এ সব বলতে গেলে উল্টে সরকারি বাসকর্মীদের একাংশের কাছে হেনস্থা ও অপমানিত হতে হচ্ছে বহু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে। এমনকী, বাস থেকে তাঁদের ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়!
আবার কোনও প্রতিবন্ধী নিজেই হুইলচেয়ারে করে বাসে উঠে যেতে পারছে না। সেই সুবিধে অর্থাৎ বাসের পাদানির সঙ্গে ঢাল বা র্যাম্প এখানে নেই। যা বিশ্বের অন্য বহু দেশে আছে। এই তো সেই দিন বনানী থেকে লোকাল বাসে শাহবাগে যাবো বলে বাসে উঠি। এমন সময় ২২ বা ২৩ বছরের এক নারী কে ঐ বাসের কন্টেক্টার নিবে না। আমি সহ প্রায় ২/৩ যাত্রী প্রতিবাদ করি। সেই নারীর ডান পা জন্মগত ভাব স্বাভাবিকের তুলনায় দু’ইঞ্চি ছোট। দু’বার অস্ত্রোপচারেও লাভ হয়নি। কোমরের নীচে, ডান দিকে ইস্পাতের পাত বসানো। কারও সাহায্য ছাড়া তাঁর পক্ষে চলাফেরা করা মুশকিল।

উন্নত দেশের চিত্র
বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে পরিচয়পত্রে তাঁর প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর তার প্রতিবন্ধীত্বের জন্য তিনি সঙ্গে ‘এসকর্ট’ বা সহায়ক রাখার সুবিধা পাবার কথা। অর্থাৎ, চাইলে সরকারি যানবাহনে প্রতিবন্ধী নিজে এবং সহায়ক দু’জনেই যাতায়াত করতে পারবেন।
সেই নারী দুঃখ করে বলেন, অনেক সময় সরকারি বাসে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সহায়ক-সহ তাঁর নির্বিঘ্নে যাতায়াতের অধিকারের কথা জানালে আমল দেওয়া তো হয়ইনা, উল্টে চালক ও কন্ডাক্টর তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও শারীরিক নিগ্রহও করেন। এমনকী ওই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বলেন, ‘‘এমনও হয়েছে, বাসের চালক-কন্ডাক্টর তাকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়েছেন। সেক্ষেত্রে যে কোন সময়ে হতে পারে বড় বিপদ।’’ তাহলে এক জন প্রতিবন্ধী বলে কি ন্যূনতম মানসম্মানটুকু নিয়ে বাঁচার অধিকার নেই?’’
প্রতিবন্ধী এ নারীর অধিকার থাকলেও তার প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে জানা নেই। তবে আমি ঢাকার রাস্তাঘাটে অনেক সময় সরকারি বাস প্রতিবন্ধী দেখলে স্টপে থামে না এটি দেখেছি। থামলেও এত অল্প সময়ের জন্য থামে যে, তাদের পক্ষে ওঠা সম্ভব হয়না। আবার কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্টপে বাস না থামিয়ে পরের স্টপে নামানো হয়। সরকারি বাসের যে সব কর্মী প্রতিবন্ধীদের হেনস্থা করেন, বেআইনি ভাবে প্রতিবন্ধীদের কাছ থেকে ভাড়া চান, তাঁদের শাস্তির কথা না চিন্তা করে আমার কাছে মনে হয়, তাদের এই বিষয় সচেতনের ব্যবস্থা থাকা দরকার বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। না হলে এই অমানবিকতার শেষ হবে না।

লেখক- বোরহান উদ্দিন
এত তো গেলো সরকারি বাসের কথা, অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের অবস্থা কি তা আপনারা খুব সহজে বুঝতে পারছেন। এটা এক জন বা দু’-একটি ঘটনা নয়, সরকারি বাসে বা ট্রেনে প্রতিবন্ধীদের কী কী অধিকার আছে, সে ব্যাপারে বহু সরকারি কর্মীরই সচেতনতা নেই। তার জন্য সচেতনতার প্রচার ও প্রসার জরুরি। সরকারি বাসে উঠতে প্রতিবন্ধীরা যাতে বাধার সম্মুখীন না হন, সেই জন্য যে সব বাসে সম্ভব, সেগুলিতে ঢালের ব্যবস্থা রাখতেও পরিবহণ দফতরকে আরো বিশেষ ভুমিকা রাখতে হবে।
সাথে নগর পিতাদেরও বড় একটা ভুমিকা রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বাসে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বাসকর্মীদের সচেতন করতে মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন অলাভজনক অর্গানাইজেশন কাজ করতে পারে। সসাধারণ মানুষ কে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাসে যাতায়াত করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা জন্য সাধারণ মানুষের ভুমিকা কম নয়।
লেখক : সমাজ উন্নয়ন কর্মী, গণমাধ্যম কর্মী ও সংগঠক borhan.2012@yahoo.com