বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসীকে মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি :: একে একে পেরিয়ে গেল ১০টি বছর। কেউ মনে রাখেনি বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মাসীকে।  কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রোগ-শোকে আর অযত্নে-অবহেলায় মৃত বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর কি হবে। গুরুদাসী কি পাবে না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি! মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা তার সর্বস্ব লুটে স্বামী-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এক দশক আগে হৃদয়ে নির্মম যন্ত্রনা নিয়ে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

তার শেষ আশ্রায়স্থল আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। তালাবদ্ধ তার বসত ঘরে আশ্রয়স্থল হয়েছে কীটপতঙ্গের। রাতে আশেপাশে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ আর নেশাখোরদের আর্ড্ডা। অথচ তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গঠন করা হয়েছিল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। আর তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেয়া হয় ওই সময়।

১৯৭১ সাল। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের গুরুপদ মন্ডল পেশায় দর্জি হলেও সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ-সরল বিনয়ী একজন মানুষ। ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সংসার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। রাজাকারদের ইন্ধনে পাক বাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়।

একে একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। তার স্ত্রী গুরুদাসী মন্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের। নিজ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহ বীভৎস করে দেয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকে মাতৃক্রোড় থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাঁশে কাদা পানির ভেতরে।

তারপর গুরুদাসীর ওপর হায়েনারা পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। পাক হানাদাররা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী গুরুদাসীকে উদ্ধার করে। নিজ চোখের সামনে স্বামী, ছেলেমেয়ের মৃত্যু এবং পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী ততক্ষণে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজাতে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদবাস্তের মতো ঘুরে এক সময় ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়।

মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান। হাতে ছোট্ট লাঠি, মানুষকে হাসতে হাসতে ভয় দেখানো আর হাত পেতে ২ টাকা চেয়ে নেয়া-এভাবেই গুরুদাসীর দিন কাটতে থাকে। গুরুদাসী হয়ে ওঠেন এলাকার সবার কাছের মানুষ, পরিচিত মুখ। পরে বাগেরহাট জেলা পরিষদের প্রসাশক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, পাইকগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী ও ততকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদার কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় গুরুদাসীর বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। সেখানেই অনাদরে, অযতেœ, অভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন তিনি।

২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে কোনো এক সময় মৃত্যু বরণ করেন তিনি। প্রভাতে নিজের শয়নকক্ষে তার মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখে পার্শ্ববর্তী লোকজন। গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুদাসীর আত্মত্যাগের কথা আজও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। এক রকম সবাই ভুলে গেছে গুরুদাসীকে। তার যে পরিবারকে নিসংসহভাবে হত্যা করা হলো এর কোনো স্বীকৃতি এখনো আসেনি।

কপিলমুনি গুণিজন স্মৃতি সংসদের সভাপতি আ. সবুর আ-আমিন বলেন, গুরুদাসী মাসীকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ তার শেষ স্মৃতিবিজড়িত বাড়ীটি রাষ্টীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হোক। ২০১৬সালে ১২অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এক গেজেটে ৪১ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে সরকার।

ওই সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ কম মোজাম্মেল হক জানান, মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বার্থে বীরাঙ্গনারা অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের অবদান কখনোই ভোলা যাবে না। এ জন্য সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সময় ও তত পরবর্তী মৃত বীরাঙ্গনাদের রাষ্টীয় স্বীকৃতি এবং তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ না করা হলে পরবর্তী প্রজন্ম ভুলবে মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের অবদান।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here