কুয়াকাটা সৈকতে ৪০ ফুট লম্বা মৃত তিমিমিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি :: পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটা সংলগ্ন গঙ্গামতি ৩৩ কানি সাগর সৈকতে ভেসে এসেছে একটি মৃত তিমি।

শনিবার সকালে সৈকতের বালুচরে এ তিমিটি ভেসে আসার খবরে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, পর্যটকসহ হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায় মাছ টি দেখতে। পর্যটকসহ সবার দাবি, এই তিমি মাছের কংকালটি সংরক্ষণ করে দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা করা হোক।

তিমিটি লম্বায় প্রায় ৩৫-৪০ ফুট, প্রস্থ্য প্রায় ১০ ফুট। তিমিটির শরীর পঁচে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এক সপ্তাহ আগে এটি মারা যাওয়ায় সাগরে জোয়ারের ¯্রােতে গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলে এসে আটকা পড়েছে। মাছটির শরীরের পেটে ও মুখের নিচে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিমির শরীরে পঁচন ধরায় মাংস পঁচে হাড় বের হয়ে গেছে।

এদিকে এই তিমির কংকাল সংরক্ষণের বিষয়ে শনিবার দুপুরে পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও এ্যাকোয়া কালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন মন্ডল এর নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি দল তিমি মাছটি সংরক্ষণের বিষয়ে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাগর তীর ঘেষে বিশাল তিমির মৃত দেহ আটকে আছে। তিমির শরীরে বিভিন্ন অংশ পঁচে সৈকতে গলে পড়ছে। শরীর পঁচে দাঁতসহ বের হয়ে গেছে বুকের হাড়। গোটা তিমির শরীর কালচে বর্নের হলেও পেটের অংশ সাদা-গোলাপী বর্নের। লেজটি লম্বায় প্রায় আট ফুট।

এরআগে কুয়াকাটায় বিশাল আকৃতির হাঙ্গর, ডলফিন ও জেলিফিস ধরা পড়লেও কখনও তিমি মাছ ধরা পড়েনি। হঠাৎ করে সৈকতে মৃত তিমি আটকা পড়ার খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে।

সামুদ্রিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটির মেরিণ এডুকেশন এন্ড ট্রেনিং কোর্ডিনেটর ফারহানা আখতার সাংবাদিকদের বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসা তিমি মাছটি ব্রিডিস তিমি বা বেলিন তিমি। এদের দাঁত থাকেনা, মুখে ছাঁকনির মত অংশ থাকে। যার মাধ্যমে এরা পানি থেকে ছোট ছোট মাছ ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী খেয়ে বাঁচে। এরা সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ ফুটের মত লম্বা হয়ে থাকে।

কুয়াকাটার জেলে আজিজ হোসেন (৬৩) বলেন, প্রায় ৩৫-৪০ বছর সাগরে মাছ শিকার করছেন। কিন্তু কখনও জালে তিমি মাছ ধরা পড়েনি। কুয়াকাটা সৈকত থেকে হিরন পয়েন্ট, দক্ষিনে সুন্দর বন, কয়েকশ কিলোমিটারের মধ্যে কখনও তিমি মাছ দেখেন নি। তবে সাগরের দেড়শ-দুইশ কিলোমিটার দূরে মাঝে মধ্যে তিমি মাছ ভেসে ওঠার সংবাদ পেয়েছেন।

উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, তিমি সিটাসিয়া বর্গভূক্ত জলজ স্তন্যপায়ী (ডেলফিনিডে বা প্লটানিষ্টয়িডে )। এরা না ডলফিন না শুশক। যদিও তিমিকে মাছ বলা হয়। আসলে এরা মাছ নয়, মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রানী। তিমির বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী নীল তিমি, খুনে তিমি, এবং পাইলট তিমি, যার নামের সাথে তিমি আছে বটে কিন্তু জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়োজনে তাদের ডলফিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

তিমিকে মোটা দাগে শিকারী প্রাণীর কাতারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর খাদ্য তালিকায় আণুবীক্ষনিক প্লাংকটন থেকে শুরু করে বড় মাছ পর্যন্ত সবই আছে। পুরুষ তিমিকে বলা হয় ষাঁড, একইভাবে স্ত্রী তিমিকে গাভী আর শিশু তিমিকে বাছুর বলা হয়। স্তন্যপায়ী হওয়ায় তিমির নিঃশ্বাস নেয়ার অক্সিজেনের দরকার। এ জন্যে তিমিকে পানির ওপর ভেসে উঠতে হয়। এ কাজটি তিমি তার সুবিশাল নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। তিমি পরষ্পরের সাথে এক ধরণের সুরেলা শব্দ করে যোগাযোগ করে। তিমি ১৬৩ ডেসিবেল শব্দ তীব্রতায় ২০,০০০ একুস্টিক ওয়াটে শব্দ তৈরি করে। বহু শতাব্দী ধরে জাপানসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ গোশত, তেল ও অন্যান্য কাঁচামালের প্রয়োজনে তিমি শিকার করে চলেছে। বিংশ শতাব্দীর ব্যাপক নিধনযজ্ঞে তিমির বেশ কিছু প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

সাগর সৈকতে ভেসে আসা এই তিমি দেখতে এসেছে স্কুল ছাত্র মনির, আশরাফ, সাব্বির, তালহা ও সুমাইয়া। তারা সবাই চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তারা জানায়, বইতে বিশাল নীল তিমির কথা পড়েছেন। আজ দেখতে পেলাম। আসলেই এটা কতো বড়। কিন্তু এটা কিভাবে মারা গেছে সেটা জানতে পারলাম না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. হাসান জানায়, কুয়াকাটয় ভেসে আসা এই তিমি মাছ মরার কারণ অনুসন্ধান করা উচিত। ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় ভ্রমনে আসা পর্যটক আরিফুল ইসলাম ও তামান্না ইসলাম জানান, বিশাল এই তিমিটির কংকাল কুয়াকাটায় সংরক্ষণ করা উচিত। যাতে পর্যটকরা বিশাল তিমি মাছ সম্বন্ধে জানতে পারে।

একাধিক পর্যটক জানান, মাছটি ওজনে প্রায় পাঁচ-সাত টন। এটি জোয়ারের আগেই সাগর তীরে উঠাতে না পারলে জোয়ারের পানিতে আবার অন্যত্র ভেসে যাতে পারে। কিন্তু দুপুর হলেও এটি সরানোর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে কুয়াকাটায় ভেসে আসা তিমিকে নীল তিমি বা কিলার তিমি শ্রেণির প্রানী মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের জলসীমায় এই তিমি তেমন দেখা যায় না। কিভাবে এটির মৃত্যু হয়েছে তা পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তিমির কংকাল সংরক্ষণ করার বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলেছেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়ের সাখে এই বিষয়ে কথা বলেছেন।

তিঁনি বলেন, এই কংকাল সংরক্ষণ করতে পারলে ফিসারি বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনেক ব্যবহারিক ক্লাসে কাজে লাগবে। ইতিমধ্যে পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিম ঘটনাস্থলে গেছেন বলে জানান। তাদের মতামত পাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here