কুমিল্লা প্রতিনিধি :: আবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচিত হয়ে বাজিমাত করলেন বিএনপি মনোনীত মনিরুল হক সাক্কু। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৮৪ ভোট। সাক্কুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট।
বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) রাত ৯টায় কুমিল্লার টাউন হল মিলনায়তনে রিটার্নিং অফিসার রকিবউদ্দিন মণ্ডল বেসরকারিভাবে এ ফলাফল ঘোষণা করেন। গতবার আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ আফজল খানকে হারানোর পর এবার তার মেয়েকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কুমিল্লার নগরপিতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সাক্কু। গতকাল সকালে সুষ্ঠু ভোটের পর দুপুর না গড়াতেই কিছুকেন্দ্রে জালভোটের কারণে পরাজয়ের শঙ্কা তৈরি ছিল সাক্কু শিবিরে। তবে রাতে বেসরকারি ফলাফলে সব শঙ্কা দূর করে বিজয়ী আনন্দে মিলিত হন সাক্কুর সমর্থকরা। অন্যদিকে সীমা শিবির জয়ের ব্যাপারী আশাবাদী হলেও দলীয় কোন্দলে এবারও আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরেছে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মেয়রের পাশাপাশি কাউন্সিলর পদেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বেশি জয় পেয়েছে। বেসরকারি ফল অনুযায়ী ২৭ কাউন্সিলর পদের মধ্যে বিএনপির ১২ জন, আওয়ামী লীগের ১১, জাতীয় পার্টির তিনজন ও বাসদের একজন নির্বাচিত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টির ভোট সম্পন্ন হয়। কুমিল্লা সিটি কলেজ কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারকে মারধরের ঘটনায় কেন্দ্র দুটির ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে কুমিল্লা সিটি কলেজ কেন্দ্রে (পুরুষ) ভোটার রয়েছে ২ হাজার ৭৭২ ও চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোটার আছে ২ হাজার ৪৮৩ ভোট। দুই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৫ হাজার ২৫৫ ভোট। ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ইসি ঘোষিত ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফলে সাক্কু ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। ব্যবধান বেশি হওয়ায় ওই দুই কেন্দ্রে মেয়র পদে আর ভোট লাগবে না।
রিটার্নিং অফিসারের ঘোষণা অনুযায়ী এ নির্বাচনে ৬৬ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচনে মেয়র পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্যদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব.) মামুনুর রশিদ ৭৬৬ ভোট ও জেএসডি মনোনীত শিরিন আক্তার ২৮৩ ভোট পেয়েছেন। ৯টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের বিপরীতে ৪০ জন ও ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
গতকাল কিছু কেন্দ্রে জালভোট প্রদান ছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কুমিল্লা সিটিতে ভোট সম্পন্ন হয়। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর এগিয়ে থাকার খবর আসতে থাকে। রাতের দিকে কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তন থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন ফল ঘোষণা করছিলেন, তখন টাউন হলের মাঠ ও রাস্তায় উচ্ছ্বসিত হাজারো মানুষ ‘সাক্কু’ আর ‘ধানের শীষ ধানের শীষ’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। ফল ঘোষণার পর গভীর রাত অবধি বিজয় উত্সবে মেতে থাকেন সাক্কু সমর্থকরা। অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যান স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীসহ সাক্কু পরিবার। তাত্ক্ষণিকভাবে দলীয় চেয়ারপারসনকে ফোন করে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
সারাদেশের মানুষেরই দৃষ্টি ছিল কুমিল্লার দিকে। কেমন ভোট হয়, গভীর আগ্রহ নিয়ে তা দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। নানা আশঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছিল ভোট শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেন কুমিল্লাবাসী। ভোটের এই ডামাডোলের মধ্যেই নিজ প্রতীক ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের ব্যালট পেপার দেখিয়ে অন্যরকম খবরের জন্ম দেন এই মেয়র প্রার্থী সাক্কু।
এই নির্বাচনে মোট ভোটার ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৭ এবং নারী ভোটার দুই লাখ ৫ হাজার ১১৯ জন। এই ভোটারদের মধ্যে অন্তত ৩৮ হাজার সংখ্যালঘু ও ৩০ হাজার নতুন ভোটার আছে।
কিছু উপ-নির্বাচন ও ছোট কয়েকটি উপজেলা নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও নতুন কমিশনের জন্য এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে বর্তমান ইসির তত্পরতা ছিল ব্যাপক। কিছু কেন্দ্র ছাড়া ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ায় সব ভোটার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী সবাইকে অভিনন্দন জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মো. নুরুল হুদা।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে এটি সাক্কুর টানা দ্বিতীয় জয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি প্রথমবার অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে আফজল খানকে ২৯ হাজার ১০৬ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন সাক্কু। তবে বাবার চেয়ে মেয়ে সীমা পরাজয়ের ব্যবধান অনেক কমিয়েছেন। তারও আগে তিনি কুমিল্লা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। গতকাল ফল ঘোষণার পর এ নিয়ে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সাক্কুর জয়ে পুরো কুমিল্লা পরিণত হয় উত্সবের নগরীতে।
ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যার পরপরই টাউন হলের নগর মিলনায়তন মাঠে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ফল ঘোষণার জন্য অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সামনে দু’পক্ষের সমর্থকের ভিড় বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ফল আসতে শুরু করলে সাক্কু সমর্থকদের উল্লাস করতে দেখা যায়। ফল ঘোষণার পরপরই নেতাকর্মীসহ বিভিন্নজনের অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসতে থাকেন সাক্কু।