জীবনবোধের অবারিত ধারা প্রকাশের বিমূর্ত প্রতীক যে কাব্যগ্রন্থ-

লেখনীতে : কবিতা কস্তা

ক্ষুধার কাব্য – কবিতার বইটি প্রকাশ করেছেন —

কবি এক ভীষণরকম অভাবময় সময়ের স্রোতে ভেসেছেন। নিজের চতুষ্পার্শের বিবমিষায় নিবদ্ধতাকে ক্ষুধার সাথে তুলনা করেছেন। যে ক্ষুধায় তিনি দগ্ধ, অনুগ্রহনীয় পরম্পরায়।
(‘আমজাদ হোসেন

দ্য হাংগ্রি ম্যান অব দ্যা ওয়ার্ল্ড-
ক্ষুধার্ত পৃথিবীর মুখ,
ক্ষুধার রাজ্যের একক রাজপুত্তুর’)।

‘ক্ষুধার নিবৃত্তি ছাড়া মানুষের দ্বিতীয় কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই’—চির অবিরাম বহমান এই বোধ তো মানুষেরই আজন্ম মনোদৈহিক জাগ্রত জাগরণ!

‘ওকে কিছু খাবার দাও আপাতত।’ কাব্যগ্রন্থে সর্ববৃহৎ কবিতা ক্ষুধার কাব্য এক নিটোল, নিরঙ্কুশ উপস্থাপনা স্মরণের

অনুভবে কবির এই অনুভূতির অরূপ প্রকাশ স্বমহিমায় জাগ্রত ও জীবন্ত। ঠিক যেমন কবি সুকুমার রায় বলেছিলেন,

“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,
পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি”।”

তেমনি কবি রফিক আজাদের ভাষায়-

“ভাত দে হারামজাদা
নইলে মানচিত্র খাবো!

সময় বয়ে চলেছে দীর্ঘতর পথে, কিন্তু ব্যক্ততায় যে ভীষণ অন্ত:মিল!

সমাজের ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষু মানুষের চাহিদাকে তুলে ধরার সহজাত উপস্থাপন ক্ষুধার কাব্য ।

বিরূপ বিতশ্রদ্ধ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে নিমগ্নতায় রেখে আত্ম-সমালোচনার ঝড়ে মেতেছেন কবি যা এই গ্রন্থটি পাঠ না করলে উপলব্ধি করা যাবে না।

“জন্মাবধি অনাহারী ওই কবি-রাজপুত্তুর,
বসে থাকে রাতদিন চৌরাস্তার মোড়ে,
ক্ষুধার পদ্য লেখে
ব্যাঙের সংসারের মতো ওর
বুভুক্ষার সাম্রাজ্য বাড়ে’
অহরহ বেড়ে যায় সমাজ সংসারের অনবদ্য অসুখ ও বিসুখের মাত্রা, যা ক্ষুধায় জর্জরিত পৃথিবীর ধ্যানে সদা সম্পৃক্ত, আচ্ছাদিত।”

সময়ের সাথে সময়ের পথে পংক্তিগুলো সত্যিই বহমান যেন। গণমানুষের অবিসংবাদিত চাওয়ার পথে বাধাস্বরূপ এই ক্ষুধার রেডএলার্ট।

“আমদানি-রফতানি ব্যুরো
বিকাশমান জনশক্তি,
জনসংখ্যার শূন্য টার্গেট
গণতন্ত্রের মোহনবিলাস,
ওর চারদিকে কেবল ক্ষুধা,
ও ক্ষুধার এক উপত্যকা,
ওকে বিশ্বাস নেই”

“রুগ্ন পৃথিবীর বিবর্ণ বার্ধক্যে জন্মাবধি আমার বসবাস।” কবিতাংশে কবি তাঁর বয়ে যাওয়া জীবনের জরা ম্রিয়মাণ ছবি অংকন করেছেন। যা পৃথিবীর অসহিষ্ণু প্রভাবের ফলেই সৃষ্ট হয়েছে।

‘সেলুলার নারী’ কবিতায় যন্ত্রের মাঝে কথা বলা এক বিনয়াবনত সৌজন্যকাতর ভরাট নারীকন্ঠের উপস্থাপনা, যার কন্ঠশূলে হৃদিক অবমাননা যেন। বহু কাঙ্ক্ষিতজনের সাথে কণ্ঠের বিনিময়কে আকুলতায় খোঁজেন কবি। ধ্যৈর্যের সীমানা অতিক্রম করার পর বিনয়সাজে সজ্জিত কাষ্ঠসম পাষাণ যন্ত্রকুহেলী নির্মমতায় আহত হন।কাহাতক সহ্য হয় এহেন পাশবিকতা! কবিতায় কবির সেই মন ভাঙ্গার যন্ত্রসৌজন্য সংলাপের প্রতি বিরক্তির মহাযজ্ঞ ফুটে উঠেছে।

জীবনটা যেন একটা ট্রেন লাইন — যা ধেয়ে চলে| সবাই লাইন ধরে টিকিট কেটে সেই ট্রেনের বুকে শপে দেয় অস্তিত্ত্ব। চলমান ট্রেনও ছুটে সওয়ারিদের নিয়ে। যদিও সবাই জানি, এই ট্রেন একদিন থেমে যাবে, নুইয়ে পড়বে নির্ধারিত চলার পথ থেকে অর্থাৎ জীবনযুদ্ধের অবসান হবে। অনন্তের বুকে ঝাঁপ দিবে বাস্তবিক স্বপ্ন ভুলে। তারপরও সবাই এগিয়ে চলি, ট্রেন চড়বো বলে! কবির মনের সরসতা; ট্রেন চলছে, টিকিট কেটে আমরা সওয়ারি তাতে। কবি মনের সচেতনতা; একদিন যাবো সবে ফিরে, অনন্ত অসীমের দুয়ারে, কবির ভাবনায় ফুটে ওঠে জীবনবোধের আকুলতা। (কবিতা-এক্সিডেন্ট)।

স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন রচে বয়ে যায় মানুষের মূল্যাবান সময়। আশা-ভরসার দোলায় এগিয়ে যায় শ্রাবন্তী- সরস জীবন। নীরবে বয়ে যায় মনোভাবনা-শৈশবের ছুটে চলা, নৈসর্গের সাথে পথচলা, অরুণোদয়ের মায়ায় জড়িয়ে ভেলা, সমৃদ্ধ ও সুখে সওয়ার হয়ে জীবন ধেয়ে চলে। শেষ বেলায় তবু অনেক কিছুই হয় না পাওয়া, স্বপ্ন-সুখের স্বপ্নই রয়ে যায়। ধরা-ছোঁয়া থেকে যায় অচ্ছ্যুৎ! হৃদয় জুড়ে থাকে সুখ-সন্ধান বিষন্নতা! তবুও আশাহত হয় না মানুষ। কবিতায় কবির হৃদয়াবেগ যেন কম্পমান জ্যোতিষী! (কবিতা-এখনও)।

“ভাঙন” কবিতাটি কবির সচকিত অনন্য আদান। জীবনের জন্যই জীবন, পরিবেশ, প্রণয়, প্রভাত, প্রত্যাশা। জীবন জুড়ে এতো অভিপ্রায় আছে-তাই জীবন গড়তে আসে নানা প্রতিকূলতা। জীবনের ভাঙন রোধ তথা অস্তিত্ত্বের মেরামতে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, সচেতনতা নেই, ভরসা নেই!

“নদীর ভাঙনরোধে ব্যস্ত মানুষের কাছে, হৃদয়ের ভাঙন-রোধ বৈরী প্রত্যাশা।” আলোচ্যাংশ মতে, যার জন্য এতো আয়োজন, এতো আলোড়ন, এতো বাগাম্বড়িতা-সেই জীবনের দুর্দিনে জীবিতের মহার্ঘ্য লুকিয়ে রাখা হয়। আজব মানুষের প্রবণতা! কবি তাঁর কবিতায় এমন আকুলতা-ই ফুটিয়ে তুলেছেন সুচারুভাবে।

“অদ্ভূত শহরে বসতি”- কবিতায় কবি বুঝিয়েছেন, বছরের পর বছর জুড়ে বাস করেও পৃথিবীটা চেনা হয় না। আপন মানা ভাব জাগে না। কবি তাঁর কবিতার পংক্তিতে বিষন্নতার সেই সুর তুলে ধরেছেন।

“বয়স বাড়েনা”- কবিতায় কবি বুঝিয়েছেন, মাংসের বয়স বাড়লেও মনের বয়স অনেকের বাড়ে না। মনের বয়স নবীন হয়ে বয়স্কদের সঙ্গ দেয় অনায়াসে, বাঁচিয়ে রাখে হাজার বছরের সমতুল্য যেন। স্বপ্নের জালে জড়িয়েই মানুষ ভেসে চলে দূর-দূরান্তের অজানা মহিমায়। কুড়িয়ে আনে সম্ভাবনা ও সমারোহের অফুরন্ত ভাণ্ডার। কবিতায় কবি এই বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন।

ফুলের প্রতি ভালোলাগা, ভালোবাসা মানুষের চিরন্তণ। সুন্দরমনের মানুষমাত্রই ফুলের প্রতি আকাঙ্ক্ষিত। বৃক্ষ তার নিজস্ব যোগ্যতায় ফুল ফুটায়, ফুলের মাধ্যমে তার সৌরভ বিকশিত হয়। ফুল ফোটার উপরে বৃক্ষ কারও হস্তক্ষেপ কামনা করে না। ফুলের ঘ্রাণে এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যের স্পর্শে সবাই বিমোহিত ও আলোড়িত হয়। তবে সবাই আবার এই মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত হয় না।ফুলের ঘ্রাণ মাধুর্য ও সৌহার্দতা গ্রহণে সকলে সক্ষম হয় না। গুণপনাকে অনেকে অবহেলা করে। সব ফুলই গন্ধযুক্ত বা সব মানুষ গুণী হয় না। সব ফুল সবাইকে আকর্ষণ করতে পারে না বা সবাইকে সবার পছন্দ হয় না।

তবে এখন আর মানুষের মধ্যে সৌন্দর্য্, সৌহার্দতা, কোমলভাব, নমনীয়তা দেখা যায় না। কবির এই আক্ষেপ যেন রীতিমতো এক দীর্ঘশ্বাস। (কবিতা–ফুলের জন্য।

“ক্ষমা করো শেখ মুজিব” কবিতায় কবি অভিভাবকসম, দেশের পিতা, দেশের সম্ভাবনার সফল ব্যক্তিত্ব, দেশমাতার এক অনন্য সন্তানের নাম শেখ মুজিবের কথা বলেছেন। ক্রান্তিলগ্নে বিদেশিদের অন্যায় আগ্রাসন থেকে রক্ষাকারী সন্তানকে দেশমাতা সুরক্ষিতভাবে রাখতে পারেননি বরং অন্যাকারীদের তুচ্ছ আঘাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে বাধ্যতা বরণ করেছেন।দেশ আজ তাই অনুতপ্ত, মর্মাহত। তারই সদয় সকরুণ অনুভূতির পাহাড় জমেছে কবির হৃদয়ে। শব্দসৈনিকের শব্দে সেজেছে আর্তনাদের করুণ সেই ভাষা।

“বৃক্ষের কথা” কাব্যের দ্বারা বৃক্ষের অনেক অনাচার, অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও দাঁড়িয়ে থাকার অসীম ধৈর্যের উদাহরণ খাড়া করিয়েছেন। যদিও এছাড়া করার কিছুই থাকে না, তার বৃক্ষ হওয়ার অভিশাপে। কবি নিজেকে আজকাল

বৃক্ষের সাথে তুলনা করেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বৃক্ষরাজির মতো অভিব্যক্তির শিকার মানুষও অনায়াসে। অর্থ্যাৎ কিছু বলার নেই, বলতে নেই- বলতে গেলেই অনর্থ, অনাসৃষ্টি-চুপ থাকাই শ্রেয়। বাস্তবিক অনুমেয় বৃক্ষেরই আদর্শ। আবার বৃক্ষ মহাকালের অনেক উত্থান-পতনের নিরব সাক্ষীও বটে। এই ভাবনা থেকেই কবি বৃক্ষের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে চান।

সর্বসম্মিলন সমাহারে “ক্ষুধার কাব্য” ব্যতিক্রমী বাক্যামোদে রচিত মৌলিক এক সৃজনশীলতার বিকাশ। সামাজিক, প্রেমিক, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারণকারী, প্রকৃতিনায়ক, দেশপ্রেমিক, সমাজ-সচেতন অনুভবে কবির অবাধ অনুরণন গ্রন্থের পাতায় পাতায়। কাব্যিক সত্ত্বায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে কাব্যগ্রন্থটি ধারণ করেন কবি।

কবি আমজাদ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজসেবক, মানবপ্রেমে ভরপুর একজন নিরলস নীরব যোগ্য কর্মী ও দেশপ্রেমিক। তাঁর শক্তিশালী লেখনিই তা সুযোগ্য প্রমাণের দাবিদার। সময়ের সাথে, যুদ্ধের মননে, জীবনানুভূতির সাজুয্যে সজ্জিত এক সোচ্চার শব্দ-সৈনিক যেন তিনি লেখনির তীক্ষ্ণ তারুণ্যে। কবির তুলনা কবি নিজেই। আদর্শ, নীতিবান সৌর্যের বিমূর্ত এক প্রতীক জ্বলে উঠেছে কবির কলমের শক্তিশালী অর্গলে। সবল, সুন্দর চয়ন, শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের এক অমিয়ধারা তিনি বইয়ে দিয়েছেন প্রতি পরতে পরতে।

ক্ষুধার কাব্য কবি আমজাদ হোসেনের এক অনন্য কাব্যগ্রন্থ। ৫১টি কবিতা নিয়ে গ্রন্থটি কবির এক অভাবনীয় ব্যক্তিসত্তার পরিচয় বহন করে।

কাব্যালোচনা

গ্রন্থের নাম : ক্ষুধার কাব্য
কবি : আমজাদ হোসাইন
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
প্রকাশক : বিভাস
৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড (রুমী মার্কেট)
মূল্য : ১২০ টাকা|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here