শংকরলাল দাশ :: দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দেশ ইকুয়েডর। ২ লাখ ৫৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটির জনসংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। এক সময়ে দেশটি স্পেনের কলোনী ছিল। ১৮২২ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটি এক সময়ে কৃষি ও পেট্রোলিয়ামে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল। দেশটিতে প্রচুর আদিবাসী জনগোষ্ঠির বাস। আদিবাসীরা আমেরিকানদের মিশ্র জাতির লোক। এবং প্রায় সব আদিবাসী লোকজনই হতদরিদ্র। এমনই একটি দরিদ্র আদিবাসীর নাম ‘সিয়েকোপাই’। বিশ্বব্যপী করোনা সংক্রমণের ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না এ জনগোষ্টির মানুষও। তাদের করোনা পরীক্ষা নেই। চিকিৎসা নেই। অথচ বাড়ছে সংক্রমণ। এ অবস্থায় অনেকেই আমাজনের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে লতাপাতা খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতেও রক্ষা পাচ্ছে না আদিবাসী জনগোষ্টির লোকজন। বরং গোটা সম্প্রদায়ই এখন বিলুপ্তির আশঙ্কায় প্রহর গুনছে।

করোনা সংক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিশাল দেশ আমেরিকা। পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশটিতে প্রতিদিন বাড়ছে কোভিড/উনিশে মৃতের সংখ্যা। প্রধান প্রধান গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে, করোনায় মৃত মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে রাস্তাঘাটে। আমেরিকার পার্শ্ববর্তী দেশের সুবাদে গণমাধ্যমের সামনে এসেছে ইকুয়েডর দেশটির কথা। এর মধ্যেই প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের ইকুয়েডর-পেরু সীমান্তের আদিবাসী মানুষদের মাঝে করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক তৈরি করেছে। এখানকার সিয়েকোপাই নামে পরিচিত আদিবাসীরাও আশঙ্কা করছেন, এই মহামারীর কারণে তাদের গোটা সম্প্রদায়ই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সম্প্রদায়ের অনেকেই করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আমাজনের ঘন জঙ্গলে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এর ফলে বিপদ বাড়ছে বৈ কমছে না।

প্রকাশিত তথ্য বলছে, ইকুয়েডর-পেরু সীমান্তের বাসিন্দা সিয়েকোপাই উপজাতি এমনিতেই বিপন্ন। অদ্ভুদ পোশাক আর সাজসজ্জার এই আদিবাসী গোষ্ঠির জনসংখ্যা সব মিলিয়ে ৭৫০ জন। তারা সকলেই একসঙ্গে বাস করেন। তাদের নারী-পুরুষে বিভেদ প্রায় নেই। এরইমধ্যে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠির ১৫ জন করোনাভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। দু’জন বয়স্ক মানুষ কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। ফলে আতঙ্ক ক্রমে বাড়ছে।

ইকুয়েডরে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। এরমধ্যে মারা গেছে ১ হাজার সাত শ’য়ের বেশি মানুষ। উপযুক্ত পরিকাঠামো ও পরিষেবা একেবারেই না থাকায় চিকিৎসা মিলছে না বহু মানুষের। হাসপাতালেও পৌঁছাতে পারছে না অনেকে। ঘরেই থেকে মারা যাচ্ছে। দেহ নিয়ে যাওয়ারও লোক নেই। ফলে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকছে দেহ। করোনাভাইরাস নিয়ে মারাত্মক আতঙ্কে রয়েছে গোটা দেশ। আর দেশের এ অবস্থার খবর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতেই চোখ পড়েছে আদিবাসীদের প্রতি।

করোনার বেহাল এ পরিস্থিতিতে ‘সিয়েকোপাই’ আদিবাসীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে তাদের বহু মানুষের মধ্যে এ রোগের উপসর্গ দেখা গেছে। তারা সরকার ও প্রশাসনকে এ বিষয়ে জানিয়েছেনও। কিন্তু করোনাভাইরাস পরীক্ষা বা তার পরবর্তী কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বরং স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, তাদের সাধারণ জ্বর হয়েছে। কোভিড হয়নি।

গত এপ্রিল মাসে সেখানে প্রথম একজন প্রবীণের মৃত্যু হয়। এরপরেই সিয়েকোপাই আদিবাসীদের নেতারা ইকুয়েডরের সরকারকে সকল বাসিন্দাদের পরীক্ষা করার অনুরোধ করেন। তবে এতে কোন সাড়া মেলেনি বলে তাদের অভিযোগ। তাদের আরও দাবি, এর আগেও বহু রোগব্যধির তারা শিকার হয়েছেন। বহু মানুষ মারা গেছেন। এখন যে অল্পসংখ্যক মানুষ বেঁচে আছে, তারা মহামারীর কবলে পড়লে গোটা সম্প্রদায়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সিয়েকোপাই আদিবাসীদের একটি অংশ চরম আতঙ্কের মাঝে এবং নিরাপত্তার খোঁজে বেশ কিছু শিশু এবং বয়স্ক মানুষ নিয়ে আমাজনের গভীরে ইকুয়েডরের অন্যতম বৃহত্তম জলাভূমি লেগার্টোকোচায় আশ্রয় নিয়েছেন। অসুস্থরা অনেকেই গাছের লতাপাতা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। লেগার্টোকোচা এমন একটি জলাভূমি, যেখানে গাছপালা আর বণ্য প্রাণী ছাড়া কিছু নেই। বণ্য প্রাণী শিকার বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। যা অসুস্থদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার সেখানে হিংশ্র বণ্য প্রাণীর হাতে আক্রমণ ও প্রাণ হারানোর ভয়ও রয়েছে। করোনাভাইরাস এমন একটি অবস্থায় মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বিপদসঙ্কুল গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।

ইকুয়েডরের আমাজন অঞ্চলে কর্মরত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিয়েকোপাইয়ের মতো ছোট আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকে চরম অবহেলা করছে। তাদের এখনও পরীক্ষা বা চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়নি। প্রশাসনেরও কোন তৎপরতা নেই। মানবাধিকার কর্মী মারিয়া এসপিনোসা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে এই সম্প্রদায়টি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সভ্যতার স্বার্থেই এই আদিম জীবনযাত্রার ধারক ও বাহক মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার ছিল। ধারণা করা হচ্ছে-পৃথিবীর অনেক দেশেই এ অবস্থা চলছে। ফলে আদিবাসীরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

 

 

 

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here