ড. কে, এম, কামরুজ্জামান সেলিম

ড. কে, এম, কামরুজ্জামান সেলিম :: রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে দেশে মাতৃভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পায়, লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যেদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সে দেশের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মানুষগুলোর মানসিকতা কেন মানবিক হয় না সেটা আমার বুঝে আসে না। তাহলে যুদ্ধ কারা করলো, কেন করলো সেটাও একটা প্রশ্ন! বিষয়টি ভালোভাবে বুঝছিও না – কারণ তখন আমার জন্মই হয়নি। তবে পড়াশোনা করে এটা জেনেছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলাসহ আপামর জনগণ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। একটাই কারণ ছিল ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজের অধিকার নিশ্চিত করা। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন সেই ন্যায্যতা, মানবিকতা ও নিজ অধিকারটুকু আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। আমার ধারণা আমরা ব্যক্তিগতভাবে এটা চর্চা করছি না বলেই সামষ্টিকভাবে সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।

২। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা হতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। আমার বাবা-মা গত ০৮ আগস্ট করোনা আক্রান্ত হন। স্থানীয় ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে তাদের দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই। যাওয়ার আগে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা যিনি করেন তার সাথে কথা বলি। খুব ভালো ব্যবহার করলেন, সব ঠিক আছে বলে জানালেন। কিন্তু হাসপাতালে বাবা-মাকে নেওয়ার পর সেখানে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ৪০ মিনিট ধরে বাবা-মা এম্বুল্যান্সই থাকলেন। রোগীদের কেন ভেতরে নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে এক নার্স বলে আগে ভর্তি হতে হবে। সেই ভর্তি হতেও আরো ৫০ মিনিট লাগলো। তারপর রোগীদের নিয়ে যাওয়া হলো এবং ডিউটি ডাক্তার আমাকে ডেকে কেস হিস্ট্রি শুনে ফোন করে সিনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলে একটা প্রেসক্রিপশন করে আমার হাতে দিল। আমি এটা দিয়ে কী করবো কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলে বলল বাইরে কোভিড রোগীদের জন্য রেড জোন আছে ওখানে যান। গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি সেখানে ডাক্তার, নার্স তো দূরের কথা কোন কাক- পক্ষিও নেই – যার হাতে আমি প্রেসক্রিপশনটা দিব। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে রোগীর চিকিৎসা করাব না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। তারা রিলিজ দিতেও গড়িমসি করে। রাত ৮.০০ রোগি ভর্তি করেছিলাম। রিলিজ পেতে পেতে রাত ১১.০০ বেজে গেল। পাশ্ববর্তী জেলার জেলা প্রশাসক ও করোনা প্রতিরোধ জেলা কমিটির সভাপতির বাবা-মার চিকিৎসার অবস্থা যদি এটা হয় তবে বাকী করোনা রোগীদের কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়। হয়তো সেকারণেই অধিকাংশ করোনা রোগী হাসপাতালে যেতে চান না।

৩। এরপর বাবা-মা কে নিয়ে রংপুর কোভিড হাসপাতালে যাই। সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমি সন্তুষ্ট। সেখানকার চিকিৎসকবৃন্দ যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। সবার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে কোভিড রোগীদের যেহেতু ফুসফুস আক্রান্ত হয় তাই সেখানে একটা Portable X-ray machine না থাকাটা হতাশাজনক। আর সেকারণেই বুকের X-ray না করে অন্যান্য parameter দেখে মাকে out of danger বলার পরও তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে।

৪। এরপর বাবা-মাকে ঢাকায় নিয়ে যাই। মাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে এবং বাবাকে আনোয়ার খান মেডিকেলে ভর্তি করাই। আনোয়ার খান মেডিকেল হাসপাতাল বাবাকে ভালোই দেখভাল করছে দেখলাম। মায়ের এখানে ( BSMMU এর ICU-তে) কিছুটা সমস্যা দেখে আইসিইউ চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অধ্যাপক কে ফোন দিলাম সাক্ষাৎ করার জন্য। তিনি আমাকে উত্তর দিলেন “আপনি জানেন না এটা ইনফেক্টেড ডিজিজ, আমি সাক্ষাৎ দিতে পারবো না। আর আমি এ সপ্তাহ হতে ১সপ্তাহ ছুটিতে থাকবো।” অবস্থা এমন যে আমি তার মালিকানাধীন ফার্মে চাকুরি করি! যাহোক আমি পরে সম্মানিত ভিসি স্যারের সাথে দেখা করে কথা বলেছি। পরে এটাও জেনেছি আইসিইউ চেয়ারম্যান ছুটিতে নেই। মনে হলো বাশের চেয়ে কঞ্চি বড়। আবার এ বিশিষ্ট অধ্যাপকরা যখন বেসরকারি হাসপাতালে বসেন তখন তারা বলতে না বলতেই রোগীর কাছে ঠিকই ছুটে যান। কারণ কী সেটা ভালো বুঝি না! যাক আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত করবেন এটাই কামনা করি। আমার মা ২৫ আগস্ট মারা গেছেন। কারো প্রতি অভিযোগ নেই। যেটুকু হায়াৎ তার ছিল সেটুকুই তিনি পেয়েছেন। তবে কিছু মানুষের মানবিকতার অভাব আমাকে খুব কষ্ট দেয় প্রতিনিয়ত।

৫। কোভিড-১৯ এখন সারা বিশ্বে। এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মেনেই একে মোকাবিলা করতে হবে। পালিয়ে থেকে লাভ নেই। কে কবে কীভাবে মারা যাবে আমরা কেউ তা জানি না। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সবসময় মাঠে থেকে কোভিড আক্রান্ত রোগীসহ অন্যদের সেবা নিশ্চিত করার ও মনোবল অটুট রাখার চেষ্টা করেছি। আসুন আমরা মানবিক হই, নিজেদের দায়িত্বটুকু অন্তত পালন করি। তানাহলে কখন আপনি নিজেও অন্যায্যতার স্বীকার হবেন তা আগে থেকে আপনি নিজেও বুঝবেন না। Nature takes its own revenge.

৬। জুনিয়রদের জবাবদিহিতা প্রশাসনিভাবে নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সিনিয়রদের জবাবদিহিতার জায়গাতো তার বিবেক। সেটা আমরা কার কাছে বন্ধক দিলাম? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এ মর্মে হুশিয়ারি না দিতেন যে, “প্রয়োজনে বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে কোভিড রোগিদের চিকিৎসা দিব”- তবে যেটুকু চিকিৎসা এখন রোগীরা পাচ্ছে সেটুকুও পেত কিনা আমার সন্দেহ হয়।

৭। ব্যক্তিগতভাবে যার যার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আমরা সমাজে সমষ্টিগতভাবে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। আর সেটার জন্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন এবং আমাদেরকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছেন।

 

 

 

লেখক: জেলা প্রশাসক, ঠাকুরগাঁও।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here