মীর আব্দুল আলীম :: ২৬ মার্চ বাংলাদেশের সড়কে মারা গেছেন ১৯ জন।একইদিন ভয়ংকর করোনায় মৃত্যু ১ জনের। এখনপর্যন্ত বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক করোনার চেয়েও ভয়ংকর। আমাদের সড়ক প্রতিদিন মানুষের তাজা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে মারা যাচ্ছে গড়ে ১৫ জন। ২০১৯ সালের ৪৭০২ টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫২২৭জন। করোনায় মৃতের লাশ ক্ষতবিক্ষত হয় না। বিকৃত হয় না। সড়ক-মহাসড়ে বেপরোয়া গতির বাস, ট্রাক, পিকআপে পৃষ্ঠ হওয়া লাশ গুলো এতটাই বিকৃত হয় যে, যারা দেখেছেন অনেকেই সুস্থ্য থাকতে পারেন না।

কারো থেতলে যায় মাথা, কারো পেট থেকে নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে সড়কে গড়ায়, কারো শরীর থেকে হাত কিংবা পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারোবা চোখ নেই, নাক থেতলানো ক্ষতবিক্ষত শরীর। রাস্তায় তাজা রক্তের বন্যা বয়ে যায় তখন। এমন বিভৎস লাশতো আমরা সড়কে প্রতিদিনই দেখছি। সড়কে মৃত্যু নেই এমন কোন দিন আর আমরা উপহার পাচ্ছি না এখন।

প্রতিদিন সড়ক আমাদের প্রাণ কড়ছেই। প্রাণতো কাড়বেই! বাঙ্গালী প্রাণ বলে কথা; যথাতথা বেশ সস্তা। সড়ক নিরাপদ করতে “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯” আইন হয়েছে। তাতে কি?আইনেরতো আর কোথাও প্রয়োগ নেই। এদেশে আইন ভাঙ্গা যায় তুড়ি দিয়ে। ওরা (চালক) তোয়াক্কা করেনা এ আইনের? পরিবহ নয়া আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের নামে পরিবহন শ্রমিকরা নৈরাজ্য তৈরি করে অনেকটা জিতে যায় পরিবহন শ্রমিকরা। হয়তো ভড়কে যায় সরকারও। আইন প্রয়োগে পিছু হটে সরকার। এতে ওদেও সাহস বেড়ে যায় আরও। সেই এরশাদ সরকারের সময় থেকে সড়কের কোন আইন হলে আন্দোলন করে জিতে যাওয়া এইতো দেখছি সবসময়।

এবার নয়া সড়ক আইন হওয়ার পর সর্বমহলের হুঙ্কারে ভেবেছিলাম সড়ক বুঝি নিরাপদ হবে। তার লক্ষন দেখিনা কোন। উল্টো ওরা প্রশ্রয় পেলো মনে হয়। দু’দিন সড়কে ওদের রয়ে-সয়ে গাড়ি চালানো লক্ষ করেছি। আন্দোলনের পর বৈঠক তারপর আবার বেপরোয়া গাড়ি সড়কে। সড়কে মানুষ মরছে, প্রতিদিন এভাবেই মরবে মানুষ।

মনে প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি খুনে সড়ক আমাদের জন্য নিরাপদ হবে? থামবে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল? “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯” আশাজাগানীয়া বটে। এ আইন হয়েছে জেনে মনে বড় আশা জাগে; তবে মনে জোর পাই কম। আমাদের কত কিছুর জন্যইতো আইন আছে, প্রয়োগ হয় ক’টার? এদেশে কঠোর খাদ্য আইন আছে তবুও প্রায় সব খাবারেইতো বিষ মিশানো থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন আছে কিন্তু এদেশের নারীরা কতটা নিরাপদ? আমাদের নারী অনিরাপদ হয়ে, ধর্ষিত হয়ে, খুন হয়ে যাবার পর নুসরাতের মত ক’টা ঘটনার বিচার হয় এদেশে। সড়ক আইন ছিলো আগেও, এখনও আছে। প্রয়োগ হয় কি?।

নয়া আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনে প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারে। তবুও আশা করতে দোস কোথায়? আসার বাসা বেঁধে না হয় নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন দেখলামই আমরা। একে বারে আশা ছেড়ে দেয়া যাবে না কিন্তু। যা ভাবিনি তাতো হচ্ছে দেশে। সড়কে সড়কে ফ্লাইওভার, সড়ক, মহাসড়ক, মেট্রো রেল, স্বপ্নের পদ্মা সেতু সেবইতো দেখছি হচ্ছে। নতুন করে জানলাম সামনের বছর ২০২০ সাল থেকে নাকি আমাদের শিশুরা নতুন বইয়ের সাথে টাকা পাবে। বয়স্ক মানুষ, দরিদ্র মানুষ, বিধবারা ভাতা পাচ্ছে। একদিন আমরা দেশের সকল নাগরিকরা হয়তো ভাতার আওতায় আসবো। ফ্রি চিকিৎসা পাব। এমন স্বপ্ন এখন দেখতেই পারি।

ভাবি সব কিছুইতো হচ্ছে। অসভ্য খুনে সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না কেন? মনে বড় সংশয়। অসভ্য মানুষের দেশের মানুষি গুলো যখন সভ্য হবে তখন হয়তো কিছু একটা হবে। এদেশের সড়ক নিরাপদ হওয়া খুব জরুরী। খুন খারাবির চেয়ে সড়কেই মানুষ মরছে বেশি। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, আহত হয়ে পঙ্গু হচ্ছে শতশত মানুষ। সড়কে আইন না মানা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ এবং অবৈধ ড্রাইভার গাড়ি চালাতে গিয়ে হরহামেশাই দুর্ঘটনায় পড়ছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না। মোটর সাইকেলে হেলমেট না থাকলে জ¦ালানী তেল না দেয়ার নির্দেশ ছিলো পেট্রোল পাম্প গুলোর প্রতি। আমরা লক্ষ করেছি সে নির্দেশ মানা হচ্ছে।

তাই মোটর সাইকেল আরোহিরা হেলমেট পড়ে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। কাজেই পরিবহনের ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়িতে জ¦ালানী না দেয়ার বিষয়টি মনে হয় জনস্বার্থে মেনে নেয়া দরকার এবং মেনে নিলে মানুষ উপকৃত হবে। আমাদের পরিবহন গুলো ঠিকঠাক থাককে পরিপাটি হবে। সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। আদৌ তা হবে কিনা তা ভাবছি। এর আগে সড়ক নিরাপদ না হওয়ার ব্যাপারে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানকে দোসা হতো। এখন তিনি নেই তাহলে কার শক্তিতে পরিবহন সেক্টর মালিক শ্রমিকরা সড়ক আইন অমান্য করছে। এভাবে চললে আইন করে কোন কাজেই আসবে না। আইন যেমন পাকাপোক্ত করতে হবে, আইন মানতে হবে, আইন মানাতে হবে, আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তবেই সড়ক নিরাপদ হবে।

আসলে আমরা বলছি অনেক, করছি কম। সব হচ্ছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না আইন প্রয়োগ না হওয়ার কারণে। এদেশে কত শত রাজীবের হাত যাচ্ছে, পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে, এখলাছ উদ্দিন, ইমাম হোসেন, শারমি, মিশুক-মনির, সাইফুর রহমানদের জীবন যাচ্ছে। থামছেই না সড়কে মৃত্যু মিছিল। আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যায়,স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে?

সড়ক দুর্ঘটনা এ কী অলঙ্ঘনীয় ব্যাপার? এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো মৃত্যুদূত, ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বিভৎস ছবি, দেখতে পাই স্বজন হারানোদের আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোন দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে, নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই।

যে দিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পরে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লংঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানিং সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সাথে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল।

দেখা গেছে, প্রায় সব ক’টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে।
এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাঙ্খিত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে।

দায়ী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদাহরণ খুব অনুজ্জ্বল। সব ক্ষেত্রেই দায়ী চালকরা পার পেয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৪৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। তথ্যানুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৬২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রুখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করি।

 

 

 

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক। E-mail- newsstoremir@gmail.com

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here