মো: মিজানুর রহমান :: বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গত ১০০ বছরে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরেছে গোটা বিশ্ব। আবার অনেকেই বলছেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকট। উলরিখ বেক বর্তমান সমাজকে অভিহিত করেছেন, “Risk Society” হিসেবে। তিনি বলেছেন,  আগের সমাজে যে রিস্ক বা ঝুঁকি ছিল সেটি ছিল প্রাকৃতিক। আর বর্তমানে যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সেটা মানব সৃষ্ট। পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, উদীয়মান ও পুনঃউদীয়মান সংক্রামক রোগসমূহ (Emerging and Re-emerging of Infectious Diseases) পরিবেশ দূষণের ফল। কেননা কোন না কোন ভাবে এগুলো পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত।

বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কোভিড ১৯ মহামারি আমাদের নিজেস্ব তৈরি সংকট। এটাকে কোন ভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে, কোভিড ১৯ জলবায়ু পরিবর্তন ও জীব- বৈচিত্র্যর সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সাথে প্রাণী জগতের যে আন্তঃসম্পর্ক তা হয় মানুষ ভুলে যায় না, হয় বিশ্বাস করতে চায় না! ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস করেই যাচ্ছে। যার ফলাফল দেখছে পুরো বিশ্ব।

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রধান ইনগার অ্যান্ডারসনের মতে, প্রকৃতি আমাদের করোনভাইরাস মহামারী এবং চলমান জলবায়ু সংকট নিয়ে একটি বার্তা পাঠাচ্ছে। তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে যে সব রোগের বিস্তার ঘটেছে তার ৭৫ শতাংশই বন্য প্রাণীদের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে।  অর্থাৎ নতুন করে সংক্রামক রোগীর প্রতি চার জনের তিনজন আক্রান্ত হয় বন্যপ্রাণী দ্বারা। তাহলে, বন্য প্রাণীদের মাধ্যমে ছড়ানো রোগীর সংখ্যাটা সহজেই অনুমেয়। এখন প্রশ্ন হল, কেন এবং কিভাবে বন্য প্রাণীর মাধ্যমে এত সংখ্যক মানুষের রোগের সংক্রমণ ঘটছে?

জীব- বৈচিত্র্য মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ বন কেটে বসতি স্থাপন করে বন্য প্রাণীদের মানব বসতির কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। বাসস্থানের অভাবে এরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষ বন্যপ্রাণী পোষা (Domestication of Wild Animals) এবং জারজাতকরণ  (বন্যপ্রাণী শিকারীদের বিনিয়োগ ছাড়া লাভ) শুরু করছে যা জীব-বৈচিত্র্য নষ্টের জন্য অনেকাংশে দায়ী। এতে করে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। যে রোগসমূহ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণ করছে তার তালিকায় রয়েছে ইবোলা, সার্স, মার্স, ডেংগু, জিকা ইত্যাদি। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন কোভিড১৯।

অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীর মতে, পূর্বসূরি সার্সের মত কোভিড ১৯ এর উদ্ভব ব্যাট বা বাদুর থেকে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পাঙ্গোলিন নামক প্রাণীটি থেকে করোনভাইরাস মানুষের মধ্যে  সংক্রমিত হতে পারে। এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত এবং আফ্রিকার বন থেকে চুরি হওয়া সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং পাচার হওয়া প্রাণী। এখন চিনে প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে কারণ  তাদের খাবারের জন্য হত্যা করা হত। এই জন্য এটি ছিল একটি মুনাফা দায়ক ব্যবাসা।  তাছাড়াও চিরাচরিত ওষুধ তৈরির জন্য ব্যাপক  ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ বুনো এই খাবার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে অভিমত অনেক বিশেষজ্ঞের। আবার সামদ্রিক প্রাণী (যেমন বেলুগা তিমি) থেকে এই রোগের সংক্রমণ হচ্ছে বলেও মনে করছে অনেক বিশেষজ্ঞ। প্রথমে প্রাণী থেকে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে মানবদেহে, তারপর মানুষ থেকে মানুষে।

আমরা জানি, মধ্য আফ্রিকায় ইবোলার বিস্তার ঘটেছিল অতিমাত্রায় ভূমির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাদুর ও শিম্পাঞ্জি খাদ্য সংস্থান ও টিকে থাকার তাগিদে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে। বেক বলেছেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিল্প- কারখানা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের সাথে সাথে নতুন নতুন মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন তার অন্যতম উদাহরণ। ১৮৮০ সালে নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮%, যা বর্তমানে ৮৫% এ উন্নিত হয়েছে। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে মানুষ ব্যাপকহারে গাছ-পালা কেটে বসতি স্থাপন করছে। এতে করে বন্যপ্রাণী তাদের বাসস্থান হারিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে তাদের খাদ্যের সংস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকার তাগিদে। এতেকরে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি। মানুষ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে নেমেছে। আর এই যুদ্ধের সবশেষ ফলাফল কোভিড ১৯। উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। সবশেষ খবর অনুযায়ী, পৃথিবীর ২০৫ অঞ্চলে বিস্তার ঘটেছে।

মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে। মানুষ ভুলে যাচ্ছে, প্রকৃতি মানুষের বন্ধু। যেখানে প্রকৃতির সাথে সখ্যতা মানুষের কল্যাণ নিয়ে আসছে, সেখানে তার সাথে বৈপরিত্য বোধ করি শুভকর হবে না। প্রমাণ আমাদের সামনে।  মানুষ যদি সেটা মানতে না চাই, তা হবে আত্মঘাতী!

আমরা ইতোমধ্যে অনেক প্রাণী পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। সেগুলো আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সচেতন্তামূলক ও দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড যখন সামষ্টিক কর্মকাণ্ডে রূপান্তরিত করা যাবে তবেই সুরক্ষা পাবে প্রাণীকূলের বাস্তুসংস্থান। জীব-বৈচিত্র্য যদি রক্ষা করা না যায়, তবে প্রতিবেশীয় ভারসাম্য রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পরবে।

লেখক- মো: মিজানুর রহমান

করোনাভাইরাস হল প্রকৃতির সাথে মানুষের যুদ্ধের ফলাফল। মানুষ তার প্রয়োজনে প্রকৃতিকে শোষণ করছে, অযাচিত ভোগ বিলাসে মত্ত হচ্ছে। মানুষের অতিরিক্ত ভোগবিলাতা আর প্রকৃতিকে শোষণের বার্তা করোনা ভাইরাসের মত রোগ। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন যে বিষয়ে সবচেয়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে তা হল মানব স্বাস্থ্য। মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। আবার সেই মানুষই নিজেকে বাচিঁয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি তারই বাস্তব উদাহরণ। আমরা ভবিষ্যতে আরও স্বাস্থ্য সমস্যা আশা করতেই পারি! আমরা যদি প্রকৃতির সাথে দ্রোহ করি, প্রকৃতি তার নিজের মতো করেই দ্রোহ করবে।

প্রকৃতির সাথে সংঘর্ষ মেটানোর সময় এসেছে। এখনি যদি সচেতন না হই, তবে মানব প্রজাতির বিলুপ্ত ঘটবে অজানা প্রাকৃতিক শক্তির কাছেই!

 

 

 

 

 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক। mizanur@idss.uiu.ac.bd

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here