জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ৬টি বধ্যভূমির মধ্যে ১টিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও ৪০ বছরেও বাকী ৫টি বধ্যভূমির সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। অরক্ষিত এই ৫টি বধ্যভূমি আজও ঝোঁপঝাড় আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে আছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী সারা দেশের ন্যায় কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। পাক বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে এনে এই উপজেলার কিছু কিছু স্থানে নির্বিচারে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। দেশ স্বাধীনের ২৪ বছর পর ১৯৯৫ সনে বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় ও সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল মৌলভীবাজার জেলায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ৮টি বধ্যভূমি বাচাই করেন। তন্মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলায় শুধুমাত্র শমসেরনগর বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করা হয় সংস্কার সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। ১৯৯৯ সালে চিহ্নিত এই বধ্যভূমির স্থান সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৭ সালে সেখানে স্মৃতি সৌধ নির্মিত হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া, প্রতাপী, চৈত্রঘাট, ছয়ছিরি ও আদিয়া বধ্যভূমিকে বধ্যভূমি হিসাবে যেমন চিহ্নিত ও বাছাই করা হয়নি, তেমনি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিসৌধ নির্মানের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব স্থানে অনেক লোককে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল পাক হানাদাররা।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগানে প্রবেশ করে পাক হানাদার বাহিনী ৭০ জন চা শ্রমিককে ধরে ভাইয়ের সামনে ভাই, পুত্রের সামরে পিতা, পিতার সামনে পুত্রকে বিবস্ত্র করে তাদের পরনের কাপড় দিয়ে প্রত্যেকের হাত বেঁধে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে ৭০ জনের মধ্যে ১২ জন চা শ্রমিক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই স্থানটি সরকার কিংবা চা বাগান কর্তৃপক্ষ সংরক্ষনের জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। স্থানটি বিরানভুমিতে পরিণত ছিল। এনিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য লেখালেখি হয়েছিল। অবশেষে গত বছর মহান বিজয়ের মাসে কমলগঞ্জ উপজেলার ১নং রহিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান (স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত) ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার আহমদ বদরুলের হস্তক্ষেপে ও দেওড়াছড়া চা বাগান কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় দেওড়াছড়া চা বাগানের বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করে চা শ্রমিকদের গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষনের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কিছু সংস্কৃার করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক টানানো হয়।
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর কমলগঞ্জে শহীদ হওয়া বাংলার ৪ মুক্তিযোদ্ধার কবর উপজেলার কামুদপুরে দেয়া হয়েছিল। উপজেলার ভানুগাছ বাজারের নিকর্টবর্তী ধলাই ব্রীজে ৩ জন ও কমলগঞ্জ থানার সামনে জাতীয় পতাকা উড়ানোর সময় অপর একজন অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। এরা হলেন কুমিলা মুরাদ নগরের কালাপাইনা গ্রামের সিপাহী মোঃ মিজানুর রহমান, দেবীদ্বারের বড় শালঘর গ্রামের সিপাহী আব্দুর রসিদ, পাবনা শাহাদাৎপুরের দারগাপাড়া গ্রামের ল্যান্স নায়েক জিলুর রহমান, চট্রগ্রামের নিরশ্বরাইয়ের মগাদিয়া গ্রামের সিপাহী মোঃ শাহাজান মিয়া। দেশের জন্য সম্মুখ যুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গকারী এই ৪ বীর যোদ্ধাকে ঐ দিন রাতেই পার্শ্ববর্তী আলীনগর ইউনিয়নের পশ্চিম কামুদপুর কবর স্থানে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দাফন করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মেজর ফিরোজের সংগৃহিত ইট ও সিমেন্ট দিয়ে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে কবরগুলো পাকা করেন। পরবর্তীতে সরকারী সহযোগীতায় সীমানা দেয়াল করার পর ২০০৫ সালে কিছুটা সংস্কার কাজ করা হয়। কিন্তু নিম্ম মানের কাজ হওয়ায় বর্তমানে মুছে গেলে নাম ফলক। অযত্নে অবহেলায় সংস্কার বিহীন থাকায় সমাধিসৌধের দেয়ালে ফাটল ধরার পাশাপাশি ভেঙ্গে পড়ছে। পশ্চিম কামুদপুরে কমলগঞ্জ উপজেলার একমাত্র মু্ক্িতযোদ্ধাদের কবরস্থান হওয়ার পরও তাদের স্মরণে স্বাধীনতা লাভের ৪০ বছরের প্রাক্কালেও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার। বাকীগুলো এখনো অরক্ষিত রয়েছে। অথচ জাতীয় স্বার্থেই এসব স্থান সংরক্ষন করা অতীব জরুরী।
আলাপকালে কমলগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মখলিছুর রহমান জানান, বর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী মহাজোট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি অবিলম্বে কমলগঞ্জ উপজেলার ৫টি অরক্ষিত বধ্যভূমিকে সংরক্ষণ করে স্মৃতিসৌধ নির্ম্মাণ করার জন্য। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ শুরু করেছে। অচিরেই কমলগঞ্জ উপজেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্ম্মানের পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করবে। এজন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/সজল দেব/মৌলভীবাজার