কালাম আজাদ, কক্সবাজার
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কক্সবাজারস’ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ও কয়েকজন কর্মচারীর সীমাহীন দূর্নীতি ও অনিয়মে স’বির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন কর্মকান্ড। শুধু তাই নয়, চলমান কাজের ব্যবহৃত উপকরণের ল্যাবরেটরী টেস্ট বাধ্যতামূলক হলেও নির্বাহী প্রকৌশলী বাস্তবে তা করেন না। কিন’ ল্যবটরীর বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় এবং প্রকল্প কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামতের নামে লাখ লাখ টাকা ভূঁয়া বিল ভাউচার করে হাতিয়ে নেয়া হয়। টাকা ছাড়া কোন ফাইল নড়ে না এই অফিসে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত অধিকাংশ ঠিকাদার তাদের হয়রাণির শিকার হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেও বিলের টাকা পাওয়া যায় না। এমন কি কাজ শেষ করে জামানতের টাকার পে-অর্ডার ফেরত নেয়ার সময়ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে উৎকোচ দিতে হয়। পে-অর্ডার ফেরত নেয়ার সময় উৎকোচ নেয়ার ঘটনা এলজিইডি কক্সবাজারের ইতিহাসে নজির বিহীন বলে কয়েকজন কর্মকর্তা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে কোন ঠিকাদার কাজ সম্পাদনের নির্দিষ্ট সময়ের পর নিয়মানুসারে স্বাভাবিকভাবেই তার পে-অর্ডার সহজেই ফেরত পাবার কথা। কিন’ এখানেও উৎকোচ দেয়া অঘোষিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। দেড় বছর আগে খালেদ চৌধুরী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কক্সবাজারে যোগদানের পর নজিরবিহীন উৎকোচ নেয়ার ঘটনা শুরু হয়। এ সব অনিয়ম, দূর্নীতি ও জালিয়তির তদন্ত দাবি করেছেন সকল ঠিকাদার ও প্রকল্প এলাকার জনসাধারণ।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কক্সবাজার জেলায় উন্নয়ন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এলজিইডি। কিন’ এখন স’বির হয়ে পড়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে খালেদ চৌধুরী কক্সবাজারে যোগদানের পর শুরু করেন অন্য রকম বাণিজ্য। তিনি গত জুন মাসে কোটেশন দেখিয়ে (যাহা বিধি মোতাবেক ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করার কথা) নিজেই অফিসের উপ-সহকারি প্রকৌশলীর মাধ্যমে অর্থাৎ তাকে ঠিকাদার বানিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা লোপাট করেন। কোটেশান দেখিয়ে কক্সবাজার পিটিআই ভবন মেরামত এর নামে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। অফিসের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ যথা কাগজ, ল্যাবটরী সরঞ্জাম, কম্পিউটার সামগ্রী, গাড়ির ব্যবহৃত তেল, রোলার ও অন্যান্য গাড়ি মেরামতসহ এ জাতীয় সকল কাজ তিনি নিজেই বা তার পছন্দের কর্মচারীকে দিয়ে সম্পাদন করে থাকেন। বিশেষ করে বিগত ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থ বছরে পূর্বঞ্চলীয় সড়ক উন্নয়ন (ইবিআরআইডিপি) প্রকল্পের আওতায় উখিয়া উপজেলার সোনারপাড়া-মনখালী-টেকনাফ বাস স্টেশন পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার সড়ক, ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মানে প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। জাইকা এই প্রকল্পের অর্থ যোগান দেয়। এই প্রকল্পের কাজে ফিল্ড টেস্ট, বালি, ম্যাকাডম ও থিকনেস্ কমপেকশন করা হয়নি। এই কারণে কাজের মান খুবই নিন্মমানের হয়েছে। বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের যে কোন স’ানে তদন্ত টিম পরীক্ষা করলেই কাজের মান যে খুবই নিন্মমানের হয়েছে তা প্রমাণিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। কাজ শেষ হতে না হতেই এই সড়কের বিভিন্ন স’ানে গর্তের সৃষ্টি ও ভাঙ্গন এবং ব্রীজ কালভার্টে ফাটল দেখা দিয়েছে। এই সড়ক নির্মাণের সময় সাব-বেইজ, কার্পেটিং ও সিলকোট এর কাজে সীমাহীন দুর্নীতি করা হয়েছে। এদিকে গত মার্চ মাসে উক্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলেও অনেক ঠিকাদার প্রায় ১০-১২কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের পরে পরিশোধ করার কথা বলে গত জুন ফাইনালে নির্বাহী প্রকৌশলী প্রায় ৫কোটি টাকা উত্তোলণ করেন। মোটা অংকের উৎকোচ(পারসেন্টেইজ) পেলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া তিনি ঢাকা থেকে ফান্ড আনার কথা বলে কমিশন আদায়, অডিট টিমকে ম্যানেজ, অতিথি আপ্যায়নের কথা বলে ঠিকাদার ও উপজেলা প্রকৌশলীদের কাছ থেকে আদায় করে নেন চাহিদামতো টাকা। তার এই অন্যায় ও অনৈতিক দাবি মেটাতে গিয়ে চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা প্রকৌশলীকে নানা অনিয়মের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলীকে দূর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে ও পদাবনতি মেনে নিয়ে নেত্রকোনা জেলায় উপ-সহকারি প্রকৌশলী হিসেবে চলে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে মহেশখালী উপজেলা প্রকৌশলীকে দু’মাস কারাভোগ করতে হয়েছে। কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে তিনি তাদের হুমকি দিয়ে বলেন, আমার হাত অনেক লম্বা।
অভিযোগ বা প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। তিনি নিজকে চট্টগ্রাম মহানগরী আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী একজন নেতার ভগ্নিপতি পরিচয় দিয়ে শুরু করেন উন্নয়ন কর্মকান্ডে অনিয়ম, দুর্ণীতি ও স্বজনপ্রীতি। এই কাজ নির্বিঘ্ন করার জন্য তিনি পাঁঁচ জন ঠিকাদার ও কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেট নিযন্ত্রণ করে চকরিয়া, টেকনাফ, উখিয়া, ও মহেশখালীসহ জেলার ৮ উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়। প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার তিনি চট্টগ্রামস’ বাসায় চলে যান। এ সময় তাকে নির্ধারিত মাসোহারা যোগান দেয় ঐ সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, এই সিন্ডিকেটের নানামুখী চাপ ও হয়রানির কারণে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স’বির হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের দাবি মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এসব বিষয়ে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকাদার জানান, খালেদ চৌধুরী প্রায় ১০ বছর আগে চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী ছিলেন। সেখান থেকে দূর্নীতির অভিযোগে তাকে বদলি করার পরও তিনি স্বাভাবিকভাবে কর্মস’ল ত্যাগ করতে পারেন নি। ঠিকাদারদের রোষাণলে পড়ে সকলের অগোচরে রাতে তাকে চকরিয়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। নতুন উপজেলা উপজেলা প্রকৌশলীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি চট্টগ্রাম শহরে অবসি’ত তার বাসায়। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পরও খালেদ চৌধুরীর সেই পুরোনো স্বভাব বদলায়নি বলে জানান ওই ঠিকাদার।
এলজিইডি কক্সবাজারে তালিকাভূক্ত একাধিক ঠিকাদার জানান, ২০০৯-১১ অর্থ বছরে লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রায় ৫০০টি আবেদন জমা পড়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলীদের কার্যালয়ে। নিয়মানুসারে নির্বাহী প্রকৌশলী এসব আবেদন যাচাই বাছাই করে অনুমোদনের জন্য তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছে পাঠানোর কথা। কিন’ তার দাবি মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই আবেদনগুলো তিনি আটকে রেখেছেন বলে অভিযোগে প্রকাশ। বদরখালী ইউনিয়নের একজন জনপ্রতিনিধি জানান, ঢেমুশিয়া-বদরখালী সড়কে ৩২০মিটার কার্পেটিং করা না হলেও চকরিয়া ডেপলপমেন্ট নামের একটি ঠিকাদারি সংস’াকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে গত জুন মাসে ১৮ লাখ টাক বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা-শাপলাপুর সড়ক মেরামত, ছোটমহেশখালী-মোদিরছড়া সড়ক পাকাকরণ, শাপলাপুরের উত্তর অংশে সড়ক পাকাকরণ, মাতারবাড়ি-কালারমারছড়া সংযোগ সড়কে ৩টি কালভার্ট নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারগণ সীমাহীন দূর্ণীতির আশ্রয় নেয়। তবুও নির্বাহী প্রকৌশলী তাদেরকে রহস্যজনক কারণে প্রায় এক কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে তার সাথে কথা বলা হলে তিনি জানান, এলজিইডি একটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকারি প্রতিষ্ঠান। যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তাঘাট হাট বাজার ব্রীজ কালভার্ট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করে াকে। তিনি জানান, কক্সবাজার জেলায় এলজিইডির উন্নয়ন কর্মকান্ডে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল নানমুখি মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে এলজিইডি’র সুনাম ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।