–এলিজা খাতুন
নিচতলা থেকে একটা সোরগোল উঠে আসছে, মধ্যবয়সী একজন মহিলার চিৎকার কান্নাকাটি। হৈচৈ চেচামেচির শব্দে আচমকা তুলির ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর বিছানায় গড়াগড়ির অভ্যেস নেই। বিছানা ছেড়ে বেসিনে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তোয়ালে হাতে ঝুল বারান্দায় যায়, রেলিংয়ের বাইরে মুখ বাড়িয়ে নিচের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখতে না পেলেও কয়েকজনের আহা উহু এ সকল শব্দে বুঝতে পারল কী ঘটেছে। বেশ কয়েকটা বাড়ির পোষা কুকুর গুলো তাদের ছেলে-পুলে ভাই বোন সহ ইদানিং সকাল বেলাতে এই বাড়ির সামনে জমা হচ্ছে। শিশুদের খেলা করার মত এ বাড়ির সামনে এক চিলতে জায়গা, এটুকুই কুকুর গুলো দখল করে রাখছে, চারপাশে গোল হয়ে কুকুরের বসে থাকা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা সভা সমাবেশ করছে- যেন ওদের মনে মানুষ জাতির প্রতি অনেক ক্ষোভ জমে আছে। নিচের ফ্লাটের ভাড়াটিয়ার বাচ্চা ছেলেটিকে মারাত্মক ভাবে আক্রমন করেছে। শিশুটির মায়ের আহাজারি শুনে বোঝা গেল। এও জানা গেল প্রথমে ছেলেটিই কুকুরের বাচ্চাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। অত:পর মা-কুকুরটি প্রতিশোধ নিয়েছে। এমন কারণে অকারণে নিচতলায় মহিলাদের জটলা নৈমিত্তিক দৃশ্য।
ছেলেটির এখন কি অবস্থা দেখার জন্য তুলি দরজা খুলে সিড়ি ভেঙ্গে তিন তলা থেকে নিচের দিকে নামতে লাগল। এ বাড়িটার সিড়ির একটি ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপের দুরুত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এবং খাড়া। এই এলাকার পুরাতন অনেক বাড়িতে সিড়িগুলোর এমন দশা। কলেজের কাছাকাছি বলে এ এলাকায় বাসা নিয়েছে তুলি। সাবধানেই উঠানামা করে, আজ সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে ; ¯িøপ কেটে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেলনা। কেবল একটা টার্ন নেমে, ‘ও মাগো’! বলে অর্ধ শায়িত হয়ে পড়েছে। উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু পায়ের পাতা ফেলে হাঁটতেই ব্যথা। পাশের ইউনিটের ভাড়াটিয়া আন্টিও নিচে গেছে বোধ হয়। প্রায় ৩ বছর হয়ে গেল এ বাড়িটায় সাবলেট থাকা। পা মচকে যাবার ঘটনাটা আজই ঘটতে হল। আজ অংকন আসবে বলেছিল।
ব্যথার ঔষধ আনাবে ধারে কাছে কেউ নেই এমন। বালিশের উপর পা উঠিয়ে কিছুক্ষণ সটান শুয়ে থাকল। ঢাকায় নারিন্দা রোডের এ বাসাতে দীর্ঘ চার বছর একাই আছে। বাবা মা ভাই বোন উত্তরাঞ্চলের একটি মফসসল শহরে থাকে। তুলি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার পাশাপাশি কয়েকটি টিউশনি করে, বাচ্চাদের পরীক্ষার জন্য টিউশনিতে প্রায় ডাবল সময় দিতে হচ্ছে, এক সপ্তাহ যাবৎ ক্লাস মিস যাচ্ছে তুলির। গতরাতে ফোনে অংকন রেগে রেগে শোনালো- “কি খবর তোর ? পরীক্ষা দেবার ইচ্ছা নেই নাকি?”
– আগামী সপ্তাহ থেকে রেগুলার হব ।
– তোর জন্য তো কিছু থেমে থাকবে না, কবে থেকে আসবি তোর ব্যাপার, শোন্- পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ হয়েছে ; সাথে কিছু নোটস্ও দিয়েছেন স্যার।
আগামী এক সপ্তাহ ক্লাসে যেতে পারবেনা জানায় তুলি, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অংকনকে নোটস্ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছে, এক ঝটকায় পারবোনা বলে দিয়েছে অংকনও।
– দেখ তুলি.. তোর বাসায় ঢোকার সময় ফ্লাটের আন্টিরা বড় বড় চোখে অস্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে থাকে… আমার খুব অস্বস্তি হয় ..
– ঠিক আছে আসতে হবেনা তোর… (এটা যে অনুরাগের কথা .. অংকনও বুঝতে পারে)
তুলিও জানে- অংকন পারবোনা বললেও নোটস্ গুলো তুলিকে ঠিক পৌছে দিতে আসবে, ওদের বন্ধুত্বটা এমনই.. তুলি ভাবে- অংকন আসলে নোটগুলো একবার বুঝে নিতে পারবে ওর কাছে। অংকন বরাবর ভালো স্টুডেন্ট।
এর আগেও টিউটোরিয়ালের জন্য তুলিকে মাঝে মাঝে নোট দিয়ে গেছে। তুলি ওর কাছে শিখে নেওয়ার আগ্রহ যতটা প্রকাশ করে, তার চেয়ে দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে অংকন শেখানোর চেষ্টা করে। সকাল-সন্ধ্যে মিলে চারটা টিউশানি করে নিজের পড়ার খরচ জোগায় অংকন। তাই তুলিও মাঝে মাঝে বলে থাকে-
– তোর অনেক টিউশন ফি জমে গেছে।
– পরে সুদে আসলে একেবারে শোধ দিবি। অংকন উত্তর দেয় ।
তুলি অনুভব করে অংকনের নিখাদ বন্ধুত্বের প্রকাশ। কলিং বেলের শব্দে তুলি ব্যাস্ত হয়, ধীরে ধীরে পা ফেলে দরজার কাছে পৌছাতে একটু দেরী হয়। অংকন জিজ্ঞেস করে- “ঘুমুচ্ছিলি ?” তুলিকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে, চেহারায় সমস্যার আভাস পাচ্ছে।
– কি হয়েছে ?
– কিছু না, আয়।
অংকন সাথে আনা নোট বের করে নাড়া চাড়া করতে থাকে, ভাবছে কোন্ কোন্ শিট তুলিকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তুলির দিকে খেয়াল করল না। তুলি খোড়াতে খোড়াতে ভেতরে গেল ; মগে ঠান্ডা পানি আর কিছু ড্রাইকেক নিয়ে ফিরে এল। এবার অংকনের চোখে পড়তেই-
– একি ! পায়ে কি হল ?
– তেমন কিছু না, সিঁড়িতে পড়ে গেছি, সামান্য চোট, ঠিক হয়ে যাবে।
অংকন এতক্ষণে বুঝলো তুলির সারা মুখে বিরক্তির ছাপের কারণ। অংকন ড্রাইকেক আর শরবত এক পলকে সাবাড় করল, বোধ হয় সকালে নাস্তা হয়নি ওর। সিরিয়াস ভঙ্গিতে তুলির দিকে আরেকটু সরে এসে বলল- “এবার নোট গুলো বুঝে নে দেখি”। এভাবে ঘন্টা দুই পেরিয়েছে দুজনের নোটস্ ঘেঁটে।
অংকন বিদায় নেবার সময় থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবে ; কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে ঔষধ এবং একটা লাঞ্চ প্যাকেট দিয়ে বলল-
– দুপুরের খাবারটা দিতে এলাম ..আর রাতের খাবার সিকিউরিটি গার্ডকে বলে আনিয়ে নিস।
অংকন সিঁড়ির ডানপাশের রেলিং ঘেষে নামছে, পাশ দিয়ে কে ওঠা নামা করছে সেদিকে খেয়াল নেই। তবে অংকনকে কেউ দেখছে না… এমন নয়। এ বাড়িটার কোন্ ফ্লোরে কোন্ ইউনিটে কাদের বসবাস তা প্রত্যেকেই জানে। অপরিচিত কেউ কোন ফ্লাটে ঢুকলে বা বের হলে স্বভাবতই সবার জানার কৌতুহল থাকে। তানজিম দ্রæত সিড়ি বেয়ে ওঠার সময় অংকনকে ক্রস করে গেলেও একটু থেমে দ্বিতীয় বার পেছন ঘুরে দাঁড়ায়। বোঝার চেষ্টা করে।
সিড়ির বাঁক ঘুরে ঘুরে নামার সময় অংকনের মুখখানা আরেকটু ভালো করে দেখে নিয়ে ভাবলো কলেজ পড়–য়া, নিশ্চয় তুলির কাছেই এসেছে।
তিন বছর ধরে তুলিকে দেখছে- রং এ চাপা হলেও পোশাক-পরিচ্ছদ-আচরণ শালীনতাপূর্ণ, নিজের পড়ার পাশাপাশি পড়ানোর কাজও করছে, জ্ঞানত কারও সমালোচনা করেনা, উপরন্তু এ যুগের মেয়ে হলেও যথেষ্ট সাদামাটা-বিনয়ী। এতকিছু তানজিমের খবর রাখার সুযোগ নেই, এসব শোনা ফুফু মার মুখে। তবে এ বাড়ির প্রত্যক ইউনিটের ভাড়াটিয়াদের কাছে সমালোচনার পাত্রী হওয়া থেকে রেহাই পায়নি তুলি। সংগ্রাম এর মধ্যে জীবনযাপন করলেও তুলি’দের এ বয়সকে কোনক্রমেই ছাড় দিতে চায়না সমাজ।
তানজিম মা’কে হারেিয়ছে ছোটবেলায়, বাবা- আজগর শেখ আপন ব্যবসায় আর রাজনৈতিক ইমেজ ডেভেলপ নিয়ে কর্মব্যস্ত। বিধবা ফুফুর কোলে পিঠে ছোট থেকে মানুষ তানজিম। সন্ধ্যের পর তুলি মাঝে মাঝে চার তলায় এসে তানজিমের ফুফুর সঙ্গে সময় কাটায়। কখনও তুলি নিজেই চা তৈরি করে নিয়ে বসে, দুজনে গল্প করতে করতে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়।
প্রতিদিন সকাল আটটা হতে সাড়ে আটটার মধ্যে তুলি গোসল সেরে ছাদে ভেজা কাপড় মেলতে উঠে। এ সময় তানজিম ড্রয়িংরুমের দরজা অর্ধেক খুলে রাখে। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসলেও দৃষ্টি থাকে দরজার বাইরে। তুলির সদ্য ¯œাত ভেজাচুল তানজিমের প্রতিটি ভোরের সংবাদ শিরোনাম। তুলি খেয়াল করেনা ব্যাপারটা। কখনও তানজিমের আচরণেও বিন্দু মাত্র প্রকাশ ঘটেনি। ছোট থেকেই তানজিম চাপা স্বভাবের। চাওয়াগুলো মুখ ফুটে প্রকাশ করার অভ্যেসটা হয়ে ওঠেনি, বাবা এবং ফুফু যদিও কোন চাহিদা অপূর্ণ রাখেনি। কিন্তু মন খুলে আবদার করায় যে স্বাদ তা পাওয়ার জন্য ‘মা’ সম্পর্কের কোন বিকল্প নেই।
তুলির প্রতি তানজিমের ভালোলাগা যতটা গুরুত্বের, তুলিকে এটা জানানো ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি তানজিমের। ভালোলাগা প্রকাশের পূর্বে তবু বেঁচে থাকে স্বপ্ন, প্রকাশ পরবর্তী অবস্থা ভাবলে অনিশ্চয়তার ধোঁয়া ওড়ে কেবল।
৯টা বেজে গেছে, তুলি ছাদে যাবার জন্য উপরে ওঠেনি আজ। সাড়ে আটটার পরে যত সময় গড়ায়- তানজিম তত উদগ্রিব হয়। ফুফু-মা টেবিলে খাবার নিয়ে তানজিমকে ডাকাডাকি শুরু করে। অফিস বলতে যদিও নিজেদের কম্পানি, তবু সময়ে অফিসে যাওয়া তার বরাবরের অভ্যেস। কৈফিয়ত নেবার কেউ না থাকলেও অনুকরণ করার অনেকেই আছে অফিসে। তবে ইদানিং প্রায় অনিয়ম হচ্ছে। ছাদে ওঠার সিড়ির দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত তানজিম, তা বলে বিরক্ত নয়।
পায়ের ব্যথায় ঘুম ঠিকমত হয়নি তুলির, সকালে ঘুম ভেঙ্গে চা টোস্ট খেয়ে বিছানায় বালিশের ভরে অংকনের দেওয়া নোটস্ আয়ত্ত করতে শুরু করল, আজ কোন বাড়তি চাপ নেই, কোন জ্যাম নেই, ঘামে ভেজার অস্বস্তি নেই, সারাদিন বিছানায় পড়ে থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি কিছুটা এগিয়ে নেওয়া।
বাবাকে ভীষণ মিস করলেও বাবার ধারে কাছে তানজিম ঘেঁষেনা তেমন। কিছুদিন যাবৎ বাবার টাইমলাইন পেজে রমা চৌধুরী নামের একটা মেয়ের নানা স্টাইলের ছবি আপলোড করা দেখতে পায়, কোন সেলিব্রেটিও নয় যে- তার ভক্ত হিসাবে বিভিন্ন স্টাইলের ছবি পোস্ট করা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। রমা চৌধুরীর প্রোফাইলে ঢুকে তার ডিটেইলস্ জানার চেষ্টা করেছে অনেকবার, তেমন কোন তথ্য পায়নি তানজিম। বাবার সাথে মেয়েটার কোন সম্পর্ক ? কে মেয়েটি ? প্রফাইল ছবি দেখে মনে হয় বাবার সাথে বয়সেরও বেশ পার্থক্য আছে… তাহলে কি ভাবতে পারে তানজিম ? বাবাকে জিজ্ঞেস করবে ? সেটা কি শোভনীয় ?
মায়ের মুখটা খুব অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ছে, আবছা স্মৃতিটুকু তানজিমের জীবনে কতটা দুর্লভ তা পরিমাপ করা যাবেনা। মায়ের আসন পূর্ণ হয়ে থাকার জন্য এক কিঞ্চিত স্মৃতি যথেষ্ট। তানজিম কোনভাবেই মায়ের জায়গায় অন্য কাওকে কল্পনা করতে পারেনা।
ইদানিং বাবা বেশ রাত করে বাসায় ফিরছে। ফুফুমা বিষয়টা খেয়াল না করলেও তানজিম পর্যবেক্ষণ করেছে। আজও রাত এগারোটার বেশি বাজে, ভাবতে ভাবতে কলিংবেলের আওয়াজ ; তানজিম নিজ রুমে শুয়ে, ফুফুমা মেইন দরজা খুলে-
– কিরে আজকাল এত রাত হচ্ছে ?
বাবা নিরুত্তর, ভেতরে আসতে আসতে টাই এর গিরা খুলে ঢিলে করে, পকেট থেকে ফোন বের করে সোফায় রেখে টিভি ছাড়ে, ফুফু মা উত্তরের জন্য হা করে তাকিয়ে নিরাশ। পুনরায়-
– কিরে ! বসলি যে, ফ্রেশ হয়ে আয় টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
– বাইরে খেয়ে নিয়েছি।
– সে কি কথা ! আমরা তোর অপেক্ষাতেই…
“অপেক্ষা” শব্দটি কানে এলো, তানজিম ভাবে- অপেক্ষা কেবল খাবার জন্য ? রাতের খাবার টেবিল তো শুধুমাত্র খাদ্য গলাধকরণের জন্য নয় ; এটা তারও বেশি কিছু। পারিবারিক সম্পর্কের জালের কোন একটি সুতো ক্ষয়ে কিংবা ছিঁড়ে যেতে লাগলে- তা নতুন সুতোর বুননে সারিয়ে তোলার পাটাতন বলা যায় রাতের খাবার টেবিল। ক্ষুদ্র পরিসরের এই সময়টুকু ব্যস্ত জীবনের সাঁকো। ব্যক্তিগত গøানি, কিংবা অপ্রাপ্তির যত ক্ষত থাকে, তাতে পারস্পারিক ¯েœহ, মমতা, আর দায়িত্বপূর্ণ আলাপচারিতা যেন মলমের প্রলেপ! আজকাল সম্পর্ক ধরে রাখতে হৃদয়ের সুতোয় বোনা জালের বুনন বুঝি আরও কিছুটা ঘন করতে হয়। সম্পর্কের নরম দুর্বল সুতোয় যতœ করে গিরা ফেলতে রাতের খাবার টেবিলের সময়টুকুর অবদান স্বীকার করতেই হয়।
মায়ের শুন্যতা থেকেই গেছে তানজিমের বুকের ভেতরে। তবে মায়ের একটা কথা আজও ফুফুমার মুখে শুনতে পায় তানজিম, মা ছোট্ট করে ডাকতেন ‘তান’। ফুফু-মা তান বলেই ডাকেন।
– তান…… খাবার দিয়েছি … চলে আয় …
আজগর শেখ স্যুট টাই খুলে ফোনসেট সোফার উপরে রেখে ওয়াশ রুমের দিকে যায়। তানজিম রুম থেকে বেরিয়ে টিভি চ্যানেল পাল্টে দিতে সোফার কাছে আসতেই বাবার ফোনসেট চোখে পড়ে, কি মনে করে ওটার পাশে সোফাতে বসে পড়ল, ফুফু মা খাবার গোছানোয় মনোযোগ। হঠাৎ রিং টোন, ওয়াশ রুমে বেসিনে পানি পড়ার কুড়মুড়ে শব্দে আজগর শেখ রিংটোন শুনছে না হয়তো, তানজিম পাশে কাঁধ বাকিয়ে দেখতে পায় ‘রমা’ নামটি ভেসে উঠেছে। পরক্ষণে মেসেজ টোন বাজে। তানজিম এতক্ষণ রমা চৌধুরীর কল রিসিভ না করলেও এসএমএস দেখার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলোনা। ওয়াশ রুমের দরজায় একবার চোখ রেখে এসএমএস টা বের করল- দু’লাইনে যা লেখা তাতে পরিস্কার বোঝা গেল, রমা চৌধুরী এবং বাবা রেস্টুরেন্টে ডিনার করে ফিরেছে। সেখানে রমা তার পার্স ফেলে এসেছে। এভাবে রেস্টুরেন্টে বা পার্কে বাবার সাথে রমা চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা তানজিমের পরিচিত মহলে কেমন প্রভাব পড়বে তা ভাবতে পারছেনা তানজিম। মাথাটা গুলিয়ে আসছে, ব্যাপারটা ভীষণ অস্বস্তি দিচ্ছে। না গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করছে, না ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে মন থেকে। ফুফু-মা খেয়াল করল তানজিম খাবার সামনে রেখে অন্যমনস্ক।
এপাশ ওপাশ করে ঘন্টা খানেক কেটে গেল, ঘুম ধরছেনা তানজিমের চোখে। উঠে সুইচ অন করে বাতি জ্বালিয়ে ল্যাপটপে বসে, আপডেট তথ্য জানার জন্য উদগ্রিব হয়ে উঠছে মনটা, ফেসবুকে ‘রমা চৌধুরী’ নামের প্রোফাইলে অনুসন্ধান শুরু হল। অনেক রাত, চারপাশ নীরব, রেস্টুরেন্টে ডিনারের টেবিলে রমা চৌধুরী আর বাবার মুখোমুখি বসার আবছা অলো আঁধারী ছবি ভেসে উঠল ল্যাপটপের পুরো স্ক্রিন জুড়ে, রমা চৌধুরীর আসনের দিকে একটু হেলে গিয়ে তানজিমের বাবার সেলফি তোলার ধরন – তানজিম এর মনের ভেতরের বিরক্তিকে ঠেলে চেহারার উপরে এনে দাঁড় করালো। সাথে স্ট্যাটাস- “সমস্ত দিনের কর্মক্লান্তি মুছে ফেলার জন্য নিভৃতের কিছু আনন্দঘন মুহুর্ত ”
এই একটি লাইন তানজিমের বুকের কোথায় যেন বেদনা সঞ্চার করছে, রমা চৌধুরীর টাইমলাইনে পোস্ট করা কয়েকটা স্ট্যাটাস এবং কমেন্টেস্ এর মধ্যে থেকেই রমা চৌধুরীর মোটামুটি পরিচয় পেয়ে গেল তানজিম- পেশায় ডাক্তার, কয়েকবছর পূর্বে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ, নিঃসন্তান। বাবার কি খুব বেশি টান ঐ ডাক্তারের প্রতি ? ঐ মেয়েকে বাবা কি মায়ের জায়গায় আনতে চায় ? উহ্ … তানজিম কোন ভাবেই তার মায়ের আসনের ভাগ কাউকে দেবে না, কিন্তু বাবা ? বাবা এভাবে বাকি জীবন একা থাকবে ? বাবার স্থানে থেকে তানজিম আবার ভাবছে….শেষ জীবনে বাবার পাশে কাউকে সত্যিই খুব দরকার। তানজিমের মাথায় নানা প্রশ্ন ভিড় করতে লাগল, মানসিক উত্তেজনা কমছে, বাড়ছে, কখনও শিথিল হয়ে আসছে। নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অথবা চেষ্টা করে না। ওর ধারণা ভালোবাসা প্রদর্শনের বিষয় নয়, তাকে ধারণ করতে হয়। তাছাড়া ভালোবাসা প্রদর্শনের মত তেমন বিস্ময়কর কিছু তানজিমের নেই, নিজের প্রতি মেয়েদের কৌতুহল বৃদ্ধির বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করার ব্যাপারখানা তানজিমের সাথে যায়না। তবে ভালোলাগার অনুভুতি নিয়ে চিন্তা বা নাড়াচাড়া করেনা তাও নয়, সাহস নেই তেমনটাও নয়।
কয়েকদিন পরে এক সকালে চা পর্বে ফুফু মা তানজিমকে উদ্দেশ্য করে-
– গত রাত থেকে কোমারের যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছেনা, ঘুমুতেও পারছিনা। ওষুধ না খেলে দেখছি রেহায় পাবোনা। আজ একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস তো
বাবা চা’এ চুমুক দিতে দিতে নড়ে চড়ে বসে বড় বোনের চোখের দিকে না তাকিয়েই বললেন-
– তুমি রেডি থেকো বুবু, সন্ধ্যায় ফিরে নিয়ে যাবো।
– ফুফু মা’র প্রশ্ন- কোন ডাক্তার, কতদূরে চেম্বার ? বাবা ধীরস্থির ভাবে বোঝাচ্ছে- আমার পরিচিত, ডা: রমা চৌধুরী। চিন্তা করোনা, খুব যতেœই দেখবে, ভালো ট্রিটমেন্ট তার।
নামটা শুনেই গা রি রি করে উঠল তানজিমের, বাবার চলে যাওয়ার পরে ফুফু মা কে প্রশ্ন করল- “সত্যিই করে বলতো, তোমার কি কোমরে ব্যাথা ? নাকি নাটক করলে ?” ফুফুমা উত্তর দিল- দু টোই।
ফুফু মা টের পাচ্ছিলেন বাবা ছেলের মাঝে দিনের পর দিন দুরত্ব বেড়ে চলছে, তানজিম ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে চুপসে যাচ্ছে। তানজিমের বন্ধু বান্ধব হাতে গোনা কয়েকজন হলেও তাদের থেকেও নিজেকে আড়াল করে চলছে ইদানিং। এভাবে চলতে দিলে অদৃশ্য মেঘ জমা হতে হতে ভারী আর অন্ধকার হয়ে উঠতে বাকি থাকবেনা। ঘরের খবর তখন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি আর সমাজের কোনাকানিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিচিত জনের কাছে তামাসার খোরাক যোগাবে। ফুফুমা কিছুৃ একটা ভেবেছেন নিশ্চয়, অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে বুঝে নিতে চান তিনি। অভিজ্ঞতা তো দুঃখ কর্মের নির্যাস !
তানজিম বিরক্তিভাব নিয়ে নাস্তা না করেই অফিস বেরিয়ে গেল।
একটা সিক্রেট অভিযান চালাবে ভেবে সন্ধ্যে হবার কিছুক্ষণ পূর্ব থেকেই তানজিমর ভেতরে ভেতরে অস্থির। অফিস টেবিলের জরুরী কাজ সেরে নিয়েছে অনেক্ষণ আগেই। ওয়াশরুমে চোখমুখে জলের ছিটা নিয়ে ফ্রেশ হচ্ছে, বেসিনের গøাসে নিজের প্রতিচ্ছবিতে তাকিয়ে চোখ স্থির হলো কয়েক মুহুর্ত। খোঁচা খোঁচা কালো চাপ দাড়িতে গাল ভরে গেছে। নিজেকে যতটা যুবক মনে হচ্ছে -ফুফু মা বোধ হয় ততটা ভাবে না এখনও, আজ ভোরেও কপালে চুমু দিয়ে ফুফু মা ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় এমনটা করতেন। রমা চৌধুরীর বয়স তানজিমের চেয়ে কত বেশি হতে পারে ? হঠাৎ বুকে জলের স্পর্শ্বে সম্ভিত ফেরে তানজিমের।
থুতনির নিচ থেকে টোপ টোপ কয়েক ফোটা জলে বুকের অংশের শার্ট ভেজা ভেজা ঠেকছে, টিস্যূ দিয়ে মুছে বেরিয়ে পড়ল, ট্যাক্সি নিয়ে ‘রমা হেল্থ কেয়ার’ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল তানজিম। চলন্ত গাড়ির মৃদু দুলুনির সাথে সাথে তানজিমের ভাবনা গুলোও দুলতে লাগল। কেন যাচ্ছে ওখানে ? রমা’কে দেখতে ? সে তো আগেই দেখেছে তার টাইম লাইন পেজে, বিভিন্ন এঙ্গেলে, বিভিন্ন্ পোশাকে। তবে কি ফুফু মার উদ্দেশ্য বুঝতে ? প্রয়োজন আছে কি ? ঘরে ফিরলে জিজ্ঞেস করলেই তো জানা যাবে। না কি বাবার অভিব্যক্তি অবোলোকন করতে ? তাতে কী লাভ ? তানজিমের বোঝা না বোঝায় কিছু কি আটকে থাকবে ? তবে কেন এই গোপন অভিযান ? নেহাত কৌতুহল ? সে তো কৈশরের আচরণ ! যুবক বয়সের কতগুলো অনুভুতির পৃষ্ঠা একে একে উল্টে এসেছে তানজিম। কিশোর বেলার চঞ্চলতা কাটিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে এখন। তাহলে রমা চৌধুরীর চেম্বারে বাবা আর ফুফু মার কর্মসূচী যাচাই বা পর্যবেক্ষণ করতে যাওয়া কি নেহাত ছেলেমানুষি ?
ট্যাক্সি ড্রাইভার কাছাকাছি গন্তব্যে চলে এসে,- ঠিক কোথায় গাড়ি রাখতে হবে জিজ্ঞেস করল। তানজিম নিরুত্তর। ড্রাইভার আবার প্রশ্ন করে- গাড়ি কোথায় রাখবে।
“যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাও। তানজিমের আনমনা উত্তর”
ড্রাইভার পেছনে ফিরে তানজিমের মুখের দিকে তাকায়। তানজিম শব্দ না করে হাতের ইশারায় গাড়ি ঘোরাতে বলল। মাথা ঝিমঝিম করছে। সিটবেল্ট বেঁধে চোখ বুজে সিটের পেছনে হেলান দিল। সন্ধ্যের ভিড় ঠেলে ট্যাক্সি চলছে। দু’পাশের সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে।
তানজিমের হ্যালুশিনেশন হয়,- লাল লিপস্টিক আর ববছাঁট চুল উঁচু করে বাঁধা রমা পারভীনের মুখ, ঠিক পাশেই অর্ধকাঁচা আর অর্ধপাকা চুলে মিশ্রিত বাবার বার্ধক্য চেহারাও দেখছে। ক্ষোভের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তানজিম দেখছে তার বোধের ঘরের দেয়ালে অসামঞ্জস্যপূর্ণ যুগল ছবির একটা নিরানন্দ ফ্রেম। এসব এলোমেলো ভাবনায় টলতে টলতে বাসার কাছাকাছি এসে ড্রাইভার কে জানিয়ে দিল তানজিম অফিসের পথে নয়, বাসায় নেমে পড়বে।
সিড়ি বেয়ে বিষন্ন মুখে উপরে উঠে গেল, সামনে দৃষ্টি। তুলির ঘরের দরজা হালকা ফাঁকা, সেদিকে মনোযোগ যায়নি তানজিমের। সোজা নিজের রুমে বাতি না জ্বেলে পা ঝুলিয়ে বেডে আড়াআড়ি শুয়ে পড়ে। ঠিক শোয়া নয়, গা এলিয়ে দেওয়া।
তুলির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বাড়িওয়ালা ফুফুমা’র সাথে গল্পটা জমেনা ইদানিং। আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে উপরে উঠতে, উপরন্তু পরীক্ষার জন্য দোয়া চাইবে। কিছুক্ষণ আগে উপরে গিয়ে দরজা লক দেখে ফিরে এসেছে। তাই হয়ত তুলি রুমের দরজা ফাঁকা রেখেছে, ফুফু মা উপরে যাবার সময় ফাঁকা দরজায় একবার উঁকি দিলেও দিতে পারেন এটা ভেবে। তানজিমের উপরে ওঠার শব্দ শুনে তুলি ভেবেছে ফুফুমা ফিরেছেন। এ সময় তানজিমের ফেরার কথাও নয়। তুলি দেরী না করে ফুফু মার সাথে দেখা করতে উপরে ওঠে। তুলির ফ্লোরের অপজিট ইউনিটের খোলা দরজার ভেতর থেকে কেউ একজন বের হল বোঝা গেল, তুলি নিচে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
মেইন দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে তানজিমের রুম পার হয়ে সোজাসুজি ফুফু মার ঘরে গেল তুলি। দু’পাশে দুটো ইউনিটের সমান জায়গা নিয়ে এক ইউনিটেই বেশ কয়েকটি বড় বড় ঘর বাড়িওয়ালাদের ফ্লাটে। ফুফু মা– ফুফু মা–বলে ডেকে তুলি এ ঘর ওঘর সবখানে দেখে কোন সাড়া পায়না। কেউ নেই তাহলে মেইন দরজা খোলা কেন ? সবশেষে তানজিমের ঘরে ঢুকে অন্ধকারে কিছু না বুঝেই বেডের পাশে গিয়ে ফুফু মা বলে ডাকে। তানজিম হাত বাড়িয়ে তুলির হাতখানা আলতো করে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল-
– তুলি ! একটু বসবে এখানে ?
তুলি চমকে উঠল, এ সময় তানজিমের রুমে শুয়ে থাকা তুলির কল্পনার ধারে কাছে নয়। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে-
– একি আপনি ? এ সময় ? সুইচ চেপে বাতি জ্বালে
– সময়টা বেশ মুখুস্ত করে নিয়েছো দেখছি !
– না.. মানে, আপনি তো এসময় সাধারণত ফেরেন না, তাছাড়া আমি ফুফু মার কাছে এলাম।
– আমাকে এক গøাস ঠান্ডা জল এনে দেবে ?
চট করে তুলি বের হয়ে ফ্রিজ থেকে একটা বোতল নামিয়ে ঠান্ডা পানি মিশিয়ে নিয়ে এল। তানজিম গ্লাসটা ধরে নেবার সময় আঙ্গুলের সামান্য ছোঁয়ায় তুলি টের পেল বেশ গরম।
– আপনার জ্বর ?
তানজিম মুখে কোন উত্তর না দিলেও চেহারার ভাবে বুঝতে পারছে তুলি, চোখ বুজে থাকা তানজিমের বিষন্ন মুখে ক্লান্তির ছাপ। তানজিম মাথা সোজা রেখে বসতে পারলোনা, অর্ধেক জল সহ গøাস পাশের টেবিলে রেখে শুয়ে পড়ল। তুলি কপাল ছুঁয়ে দেখবে কিনা ভাবছে। তানজিমের কাছে এগিয়ে এসে দ্বিধান্বিত হাত বাড়িয়ে কপাল স্পর্শ্ব করল, ভীষণ তাপ। জিজ্ঞেস করল ঘরে কোন ট্যাবলেট আছে কিনা। উত্তর নেই তানজিমের।
তুলি দ্রæত নিচে নামে। নিচের পাশের ইউনিটের অনেকেই সিড়ি বেয়ে ওঠা নামা করছে, বোধহয় ছাদে উঠেছে তারা। তুলির ক্রস করে যাবার সময় হয়ত কৌতুহল চোখে তাকাচ্ছেও ওর দিকে। তুলি নিজের ঘর থেকে দুটো ট্যাবলেট নিয়ে উপরে উঠল আবার। ঔষধসহ জলের গøাস তানজিমের সামনে এগিয়ে ধরে-
এবারও কোন রেসপন্স নেই তানজিমের, কি করবে বুঝতে না পেরে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বেডের কোনে। বারবার কানে ভাসছে তানজিমের কাতরভাবে বলা কথা- “তুলি! একটু বসবে এখানে ?” এ স্বর তুলির মনের গহীনে কোথায় যেন নক করছে। সে কি নেহাত জ্বরের কষ্টে ? নাকি আরও কোন টান ?
ফুফু মা ফিরে আসা পর্যন্ত তুলি তানজিমের কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। তানজিম ঘোরের মধ্যে একটা নির্ভরতার ছোঁয়া টের পায়। তুলি বাইরে কার যেন ছায়া টের পায়, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কারা যেন ফিসফিস করছে… ক্ষনিকেই আবার নিস্তব্ধ।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেন দরজার বাইরে হঠাৎ কতকগুলো গলার আওয়াজে একসাথে সোরগোল বেধে গেলো। কয়েকটি স্বর পরিচিত, মনে হচ্ছে নিচের ফ্লাটগুলোর ভাড়াটিয়া ক’জনের কন্ঠ। সেইসাথে যোগ হয়েছে স্থানীয় কিছু উঠতি বয়সের ছেলেপেলে। তুলি উপরে তানজিমের ঘরে আসা থেকে এই মুহুর্ত পর্যন্ত প্রায় আধাঘন্টা পার করেছে ইতোমধ্যে, বাইরে কি হচ্ছে বুঝে উঠার আগেই ফুফু মা বাসার ভেতরে প্রবেশ করে, পেছনে আরও ক’জন। একেক জনের মুখে এক এক রকম কথা তুলির কানে আসছে, তুলি স্তম্ভিত! এসব কি শুনছে ?
কেউ বলছে- “এসব বেলেল্লা মেয়েছেলে সুযোগ সন্ধানী, ফাঁকা বাসা পেয়ে-”। একজন বলছে- তানজিমের ফুফু মার সাথে এত মাখামাখি দেখে আগেই বুঝেছি এর অন্য মতলব”। আবার দু’একজন বলছে- “আজ তো হাতে নাতে, কোন ছাড় নেই”। তুলির কান গরম হয়ে যাচ্ছে, কি করবে বুঝতে পারছেনা। প্রচন্ড রাগে মাথা ঘামছে, সে তো কোন অন্যায় করেনি ! কিন্তু এখন কে শুনবে তুলির কথা, এতগুলো সাধু মানুষকে তুলি একা কী করে বুঝাবে ? যদিও ভয় পাচ্ছেনা, তবে আতœসম্মান নিয়ে টেনশন করছে। জলপট্টি দেবার জন্য যে জল এনেছিল তা পায়ে হোঁচট লেগে পড়ে যায়, ফুফু মা ঘরে ঢুকে লাইট না জ্বালিয়েই আবছা আলোয় তুলির উপস্থিতি টের পেয়ে বলে-
– কি ব্যাপার ? তুমি এ সময় এ ঘরে কেন ? তানজিম তো এসময় বাসায় ফেরেনা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এমন পরিস্থিতি তুমি তৈরি করতে পারো।
– ফুফু মা বিশ্বাস কর
– চুপ কর তুমি …. সাফাই নিও না… যখন দেখছো আমি বাসায় নেই … কেন আছ এখানে ?
তানজিম শুয়ে শুয়ে উত্তর দেয়- “ও আমার জন্য এখানে আছে…. সবটা না জেনেই দোষারোপ করোনা… এসব নোংরা লোকজন কে বাসা থেকে বিদেয় কর।”
বাইরে থেকে কান পেতে একথা শুনে সোরগোল বেড়ে ওঠে আরও- তারা কোনভাবেই বরদাস্ত করবেনা, কোনভাবেই সমাজে অনিষ্ট হতে দেবেনা.. সমাজ কে কলুষতা থেকে উদ্ধার করতে সর্বোপরি চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে তুলির মত মেয়েদের আপবাদ দিয়ে সমাজচ্যুত করবে। অনেকেই বলতে লাগল- “এ মেয়ের বুকের পাটা শক্ত, অন্যায় করে আবার জোর গলায় কথা বলে”
ফুফু মা সুইচ চেপে বাতি জ্বালিয়ে তানজিমকে দেখেই বুঝলো, মাথায় জলপট্টি দেখে সমস্ত ঘটনা তার কাছে পরিস্কার হলো, কাছে এগিয়ে কপালে হাত রেখে বুঝতে পারে প্রচন্ড তাপ, জ্বরে কাতরাচ্ছে ছেলেটা, কিন্তু বাইরে যেয়ে কাউকে বোঝাবে সে পরিস্থিতি আর নেই, ততক্ষণে বাইরের পরিবেশ উত্তপ্ত। ফুফু মা চট করে বাইরে যেয়ে সবার উদ্দেশ্যে জোর গলায়-
– তোমাদের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি, কাকে কি বলছো ? ও এ বাড়ির বউ হতে যাচ্ছে…
– তার মানে ? (উপস্থিত অনেকের অবাক-প্রশ্ন)
– মানে তানজিম তুলির বিয়ে ঠিক হয়েছে… কদিন বাদেই তো সবাই জানতো ; আজ আমি ফোন করে তুলিকে বাসায় থাকতে বলেছি, তানজিম অসুস্থ্য শরীরে একা ছিল বলে।
তুলির মাথা যেমন গতিতে তপ্ত হয়ে উঠেছিল… বোধ হয় তারও বেশি গতিতে শীতল হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। এটা কি বলল ফুফু মা ! তানজিম, তুলি দুজনেই এ কথা শোনে। ঘরের ভেতরে দুটি প্রাণী ভীষণ নীরব ! ফুফু মা সব বলা শেষ করে বেশ গম্ভীরভাবে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে থাকলো। মুখ চুপসে একে একে সবাই বিদায় নেয়। তুলি খুব ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুফু মা’র পেছনে এসে দাঁড়ায়,
– ফুফু মা ! এসব কী বললে তুমি ?
– এই মুহুর্তকে সামলাতে এভাবে বলা ছাড়া উপায় ছিল না… ওদের মিথ্যে অপবাদ থেকে তোদের বাঁচাতে এটুকু মিথ্যে বলা দোষ মনে করিনি।
– কিন্তু এখন কি হবে ? তুমি যা বললে …..
– আমি যা বলেছি তাই হবে…. তোর কোন আপত্তি আছে ?..
তুলি শিউরে উঠলো, মাথানিচু করে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে ; কী বলবে এমন পরিস্থিতিতে ! ভীষণ টানাপোড়েন চলতে লাগল ওর মনের গহীনে। নীরবতাকে সম্মতি ভেবে তানজিমের ফুফুমা বললেন-
– তোকে এসব ভাবতে হবে না। তানজিমের ব্যাপার আমি দেখে নেব।
এ সম্পর্কে তানজিমের আপত্তি থাকবে না সেটা ফুফু মা হয়ত আঁচ করেছেন। সত্যিই তানজিমের আপত্তি নেই, বরং তুলির প্রতি বরাবর টান অনুভব করেছে। শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে তানজিম ফুফুমা আর তুলির কথাগুলো শুনছে। কিন্তু এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তানজিম তুলিকে পাবে এটা তার কাম্য নয়। একটা নোংরা ঘটনা মোকাবেলা করার সুবাদে তুলির সাথে সম্পর্ক গড়তে হবে এটা তানজিম মেনে নিতে পারছেনা, তুলিকে ভালোবাসে এ কথা জানানোর জায়গা নেই, কিংবা জানাতে পারলেও দুজনের বিয়ের কারণ হিসেবে এ ঘটনাকেই গণ্য করা হবে।
সমস্ত রাত জ্বরের তপ্ততায় তানজিম মাথা ব্যথায় কাতর, অনুভব করেছে একটা শীতল হাতের পরশ কতখানি প্রয়োজন ছিল তার, জীবনের কিছু কিছু সংকটপূর্ণ সময় একা পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। রমা চৌধুরীর প্রতি বাবার মনোযোগও আগামীর অসহজ সময় অতিক্রম করার পূর্ব প্রস্তুতি, রমা চৌধুরীর প্রতি তানজিমের ঘৃণাভরা ভাবনাটা শিথীল হয়ে আসছে বোধ হয়। ঘুমের অসাড় তলে ডুবে যেতে যেতে মায়ের ছবিটা চোখে ভেসে আসছে।
ভোরবেলা থেকে ফুফু মা তানজিমের সাড়া না পেয়ে ভাবছে আজ অফিস যাবেনা বুঝি, ভালোই হলো ওকে নিয়ে শপিং এ যাবে, সাথে তুলিকেও নেওয়া যাবে, দুজনের পছন্দ মত বিয়ের সব কেনা কাটা করে ফেলবে। খাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, এখনও ওঠেনি দেখে ফুফু মা ডাকার জন্য ঘরে গিয়ে তানজিমের কপালে হাত ছুঁয়েই-
– ওমা ! কপালটা এত গরম ? এখনও জ্বর কমেনি তোর ? তান…. এই তান… তানজিম….
সাড়া নেই।
হাসপাতালে ওয়েটিং সিটে বসে আছেন তানজিমের বাবা, ফুফু। অস্পষ্ট একটা মুখ তানজিমের চোখের সামনে, ঠিক রমা চৌধুরীর মত, হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কি ? কি জানি, ছবিতে যে রমা চৌধুরীকে দেখেছে- বয়কাট চুল, সানগøাস চোখে, নীল টি-শার্ট পরা এক তরুনী, ইনি তো তিনি নন ! মুখটা রমা চৌধুরীর মত হলেও এপ্রোনের নিচে সাদামাটা শাড়ি পরা, প্রবীন এক নারীর ¯িœগ্ধ প্রতিমুর্তি ! ছোটবেলায় দেখা ঠিক মায়ের মত। জ্বরে কপাল পুড়ছে ? না কি অন্য কোন তাপ, অন্য কোন ব্যথা, চাপ ? মায়ের স্থান গ্রাস করতে চাওয়া রমা চৌধুরী নামের ঐ উগ্র তরুনীকে গ্রহণ করতে না পারার উত্তপ্ত যন্ত্রণা ! ঘোর লাগা চোখে ভর করছে আরও আরও ক্লান্তি, জ্বর কমার বদলে বাড়ছে। সকাল থেকে সারাদিন ঘুরে ফিরে এসে দেখছেন সাদা এপ্রোন পরা সেই একই ডাক্তার। দিন শেষের একটা সময়ে তানজিমের কপালে শীতল নরম হাতের পরশ, ঘোরের ভেতরেও টের পাচ্ছে। চোখ খুলে দেখার শক্তি নেই, পড়ন্ত বিকেলে কোমল কন্ঠে- ঠিক যেন ছেলেবেলায় শোনা মায়ের মত আওয়াজ ওর কানে ভেসে এল-
– তান ! খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা ?
ঘোরের মধ্যে তানজিমের উত্তর- ‘মা ’! চেষ্টা করে চোখের পাপড়ি মেলে আবার দেখে এপ্রোন পরা মাতৃমূর্তি ; প্রশ্ন করল-
– আপনাকে খুব চেনা লাগছে, আচ্ছা আপনার নাম কি ?
– আমার নাম রমা।
– ডঃ রমা চৌধুরী ! উনি তো টি-র্শাট-জিন্স পরেন, অল্প বয়সি, মডার্ণ তরুণী !
– ছিলাম একসময়
তানজিমের কাছে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে ওঠে, সেই একসময়ের ছবিই দেখেছে এতদিন, সম্মুখে দেখা হয়নি ডঃ রমা চৌধুরীকে। তানজিমের মুখের আড়ষ্টতা ধীরে ধীরে কমে আসছে, বেশ নড়ে চড়ে উঠে বসার চেষ্টা, সতেজ কন্ঠে বলে উঠল- বাবা কোথায় ? আমি বাড়ি যাবো।
– তোমাকে তো আজ ছাড়তে পারবো না।
– তাহলে আপনিও চলুন।
পরদিন তুলির বাবাকে ফুফু মা ফোনে আসতে বলে, নিয়ম মত বিয়ের সব আয়োজন করতে ব্যস্ত।
এদিকে মাঝরাতে বাবার ফোন, বাবার কথায় ঝড়ের আভাস। বিত্তবান পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিতে মন সায় দেয়না তার। প্রায় সাত বছর আগে এমনই এক বিত্তবান লোকের মিথ্যে ষড়যন্ত্রে চাকরিচ্যুত হয়েছিল তুলির বাবা। অপরাধ ছিল- কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে অযথা জোট পাকানো, ঈদবোনাস পাওয়ার দাবি পূরণে খেটে খাওয়া নিঃস্ব মজুরদের নিয়ে সভাসমিতি করা, মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। সে বছরই গ্রামে চলে যায় তুলির বাবা, সংসারের শত অভাব-কষ্টের মধ্যেও তুলিকে পড়াশোনা করায়।
তুলি পরিস্থিতির চাপে বিধ্ধস্ত। বাবার জীবনের সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনা। বিত্তবানদের প্রতি বাবার ঘৃণা-ক্ষোভ-ধারণাকে এড়িয়ে যেতে পারেনা। আবার সব বিত্তবানই যে পচে গেছে তাও বিশ্বাস করতে মন চায় না তুলির। এই বিয়ে কতখানি অর্থবহ হয়ে উঠবে ! বিয়ের চেয়ে তুলির কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল… ফুফুমায়ের কথার মান রাখা, এতগুলো মানুষের কাছে ফুফু মাকে কোনভাবেই ধোকাবাজ প্রমান করতে পারে না তুলি।
সারারাত ঘুম নেই চোখে, প্রতি মুহুর্তে তুলি ভেবে যাচ্ছে- হুট করে নতুন জীবনে পা রাখার বিড়ম্বনা, একদিকে তানজিমদের বিশাল বাড়ি, অর্থ-প্রাচুর্য, সম্পত্তি, আর গাম্ভির্যে পরিপূর্ণ তানজিমের মন, অন্যদিকে তুলির দারিদ্রতা, সংসারের অভাব-অনটন, সরল জীবনযাপনের দুরন্ত দিন, নি¤œমধ্যবিত্ত স্বপ্ন, অংকনের সহজ বন্ধুতা, ক্যাম্পাসে বন্ধুদের আড্ডা, বিয়েতে বাবার আপত্তি ; এই বিপরীত স্রোত ! কি করে সামলাবে ? এমন জটিল অবস্থা থেকে কি করে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বার করবে ? সবসময় সে বাবার চেতনাকে মাথায় রেখেছে, জীবনের সমস্যাগুলোতে বাবাই এক মাত্র ভরসা তুলির, ভোরেই বাবা এসে হাজির হবেন, পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে ! দোটানার মাঝখানে তুলির নির্ঘুম চোখের কোণ উপচে গড়িয়ে আসছে অসহায়ত্বের নোনা জল ; রাত্রির ক্যানভাসে ওর নির্ঘুম চোখ দুটো জল রং-এ অপেক্ষার ভোর এঁকে চলেছে !