গত এক বছরেই পুলিশ এবং সাধারণ নাগরিক মিলিয়ে ৩২০ জনকে তারা খুন করেছে বলে বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করল সিপিআই (মাওবাদী)। নিহতদের মধ্যে ১৭০ জনই সাধারণ নাগরিক। তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের।
ঘটনাচক্রে, ওই বিবৃতির তারিখ গত ২০ নভেম্বর। মাওবাদীদের শীর্ষ নেতা কিষেণজির মৃত্যুর চার দিন আগে। বিবৃতির বক্তব্য, ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’-এর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা ‘যুদ্ধ’ চালাচ্ছে। তার পরিণতিতেই এত মৃত্যু। ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ তাদেরও ১৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের সদস্য দেওজি-র নামে জারি-করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগঠন পিএলজিএ (পিপল্স লিবারেশন গেরিলা আর্মি)-র ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে শুক্রবার (২ ডিসেম্বর)। সেই উপলক্ষেই এই বিবৃতি।
কিষেণজির মৃত্যুর পরে এপিডিআরের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলি ‘ভুয়ো সংঘর্ষে’র অভিযোগ তুলেছে। ওই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তও চেয়েছে। তা হলে মাওবাদীদের কবুল করা এই মৃত্যুর খতিয়ান সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা কী? এপিডিআরের সহ-সভাপতি অমিতদ্যুতি কুমার বলেন, “এত মানুষের মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্র এবং মাওবাদী উভয় পক্ষই দায়ী। রাষ্ট্র ও মাওবাদী উভয়পক্ষ ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে চলছে। দু’পক্ষের মধ্যে বার বার আলোচনার মধ্যে দিয়েই হিংসা ও মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।” অর্থাৎ, মাওবাদীরা পুলিশ এবং সাধারণ নাগরিককে খুন করার কথা নিজেরাই বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করলেও এপিডিআর কিন্তু সেই ‘হত্যালীলা’র দায় সরাসরি কিষেণজির দলের উপর চাপাতে চায়নি। রাজ্যের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল তৃণমূল ও সিপিএমের অবশ্য বক্তব্য, এত মানুষের মৃত্যুর প্রধান দায় মাওবাদীদেরই। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম দু’জনেই বলেছেন, মাওবাদীদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যেই হিংসা রয়েছে। সেলিম বলেন, “মাওবাদীরা যে হেতু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাই এই মৃত্যুকে এক বছরের যুদ্ধের লাভ-লোকসান হিসাবেই তারা দেখছে।’’ সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুকে সাধারণত মাওবাদীরা স্বীকার করে না জানিয়ে সেলিম বলেন, “ওরা যে ১৭০ জনের মৃত্যুর কথা বলেছে, ওরা তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু তার বাইরেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ওরা কখনওই তা স্বীকার করবে না।”
পক্ষান্তরে, মুকুলবাবু মনে করেন, মাও-এর নাম নিয়ে হত্যার রাজনীতি কায়েম করে জঙ্গলঘেরা দুর্গম জায়গা নিজেদের দখলে রাখতে চাইছে মাওবাদীরা। মুকুলবাবুর মতে, উন্নয়নের মাধ্যমে এদের জনবিচ্ছিন্ন করতে পারলে তবেই মৃত্যু-মিছিল বন্ধ হবে। তাঁর কথায়, “৪০ বছর আগেই নকশালপন্থীদের চিনের নেতারা বলে দিয়েছিলেন, তাঁরা হত্যার রাজনীতি সমর্থন করেন না। কিন্তু তার পরেও মাও জে দং-এর নাম করে মাওবাদীরা হত্যার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। যা ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে অচল।”
এপিডিআর, বন্দি মুক্তি কমিটি, অন্ধ্রপ্রদেশ সিভিল লিবার্টি কমিটি এবং পিইউডিআর-এর পক্ষ থেকে যৌথ ভাবে এ দিন বলা হয়েছে, কিষেণজির মৃতদেহে যে রকম ক্ষতচিহ্ন ছিল, তাতে মনে হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যু হয়নি। ওই চারটি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০ জন প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। পিউডিআর-এর গৌতম নওলাখা বলেন, “কিষেণজির মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিরপেক্ষ তদন্তে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। মাইকে তিন দিন ধরে প্রচার হয়েছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তা ঠিক নয়। এক হাজার রাউন্ড গুলিও চলেনি। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।” কিষেণজির মৃতদেহের নানা ছবি দেখিয়ে তাঁরা যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলারও দাবি করেছেন।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/ডেস্ক রিপোর্ট