মামুন সোহাগ
দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের ভয়াল ছোবল। কোথাও বের হতে এন্ট্রি পাস। মুখে মাস্ক। লকডাউনে সড়ক যেনো একেবারে ফাঁকা। সেদিনও রমজানের দিন। ধানমন্ডিতে ইফতার শেষ করে সন্ধ্যা ডুবতেই ঢাকার বাসা মিরপুরে ফিরছি। আঁগারগাও পার হয়ে তালতলাকে কেবল রিক্সায় আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম পেছন থেকে কিছু একবার ধাক্কা লাগলো। তিনবার উলটে গড়িয়ে পড়ে টের পেলাম হাত থেকে, পা থেকে চুইয়ো রক্ত ঝরছে। শোওয়া অবস্থাতেই কে একজন ফোন করে জানালো ফয়সাল ভাইয়ের কি হয়েছে?
কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। একদিকে শরীরে তীব্র ব্যথায় নড়তে পারছি না। অন্যদিকে ফোনের ওপাশের খবরে মনে হচ্ছে কিছু একটা হতে হচ্ছে। হতে চলেছে। নিশ্চিত হতে আরো কয়েকজনকে ফোন করলাম, কি হয়েছে ফয়সাল ভাইয়ের। ভাইয়ের নাম্বারে ফোন করতেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি। আহাজারি। ‘আমি ফয়সাল ভাইয়ের বোন বলছি। আমার ভাই আর নেই’ বলেই আছড়ে পড়া কান্নার শব্দ। গা হিম হয়ে আসছে। আমি ঠিক কি শুনছি, সত্যি কিনা। আসলেই এমন কিছু কিনা…না কিছুই বুঝতে পারছি না। নিশ্চিত হতে একে একে কয়েকজনকে ফোন করি। সবারই একই কথা। একই জবাব। সত্যিই শুনেছি, যা শুনেছি।
অথচ আগের রাতে ইফতারের পরই ফোন করেছিলাম ভাইকে। কখনো শোনা হয়নি আপনার শরীর কেমন। তবে সেদিন জিজ্ঞাস করেছিলাম, কক্সবাজারে এতদিন কেনো থাকছেন ভাই। শরীর ভালো ত? কবে ফিরবেন! একই কথা, অন্য দিনের মতো উত্তর দিছিলেন- ‘দ্রুতই ফিরবো। সুস্থ আছি। ঈদের আগেই দেখা হবে। বাড়ি যাওয়ার আগে ফোন দিও সোহাগ। অবশ্যই অফিসে এসো। দেখা করিও।’
শেওড়াপাড়াতে একদিন সকালে শুয়ে আছি। ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই মেসেজে জানালেন, ইউনাইটেড নিউজের ফয়সাল ভাই বেশ ভালো মানুষ। তাঁর এলাকার বড়ভাই। আমি যেনো দেখা করি। বেশ হেল্পফুল মানুষ।- যেই কথা সেই কাজ। ফোন করতেই বললেন। আসেন, দেখা হোক।
শেওড়াপাড়া মনিপুর স্কুলের গলিতে অনলাইন পোর্টালের এক ছোট অফিসে গিয়ে কথা ফয়সাল ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই আমার প্রতি যে আগ্রহ, স্নেহ ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেটা সত্যিই অবাক করার মতো। এতোটাও প্রত্যাশা করিনি। ঢের প্রাপ্তি। কাজের কথায় সময় সেদিন সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। তারপর অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। একসঙ্গে, সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছি।
আমার জীবনে যতজন মানুষকে মনে রাখতে হবে। চিরজনম কৃতজ্ঞ থাকা লাগবেই। তাঁদের মধ্যে একজন ফয়সাল ভাই। আর্থিক, অনার্থিক পরামর্শ সবভাবে ভাইকে সবসময় পাশে পেয়েছি। আদর স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। সত্যি বলতে আমি যত জায়গা ঠিক ওইসময় যেতে পারিনি, রিচ করতে পারিনি সেটা করে দিতেন ফয়সাল ভাই। না, উনি আমার রক্তের কেউ নন। তবে কিছু সম্পর্কের হৃদ্যতা এতই প্রগাঢ় হয় যা রক্তের চেয়েও আপন। ভীষণ ভালোবাসা থাকে যেখানে। এটাই হয়তো তেমনই।
আজ সেই ৩০ এপ্রিল। ফয়সাল ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। আজও রোজা। কদিন বাদেই ঈদ। তাই বাড়ি ফিরছি। এবারও দেখা হলো না। ওপারে নিশ্চয়ই ভালো আছেন। দেখা হবে ভাই। আপনার বলা কথাটা বারবার এই ট্রেনযাত্রায় মনে পড়ছে, ঈদে বাড়ি যাবার আগে অবশ্যই দেখা করিও। আজ আপনি নেই। ভাবি আছে, সামিন আছে। তাদেরকেও যেনো সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন, দেখে রাখেন। আবার তবে দেখা হবে। এপারে না হোক, পরপারে। দেখা হবে প্রিয় ফয়সাল ভাই। আমি বিশ্বাস করি, অনুভব করি। আপনি বেঁচে থাকলে আগের চেয়েও আমাদের সম্পর্ক অনেক মজবুত হতো। অনেক কাজ একসঙ্গে করতে পারতাম। শ্রদ্ধা।