এএইচএম নোমান :: গ্রাম উন্নয়ন সমবায় ও উৎপাদন নিয়ে রামগতি উপকূলীয় এলাকায় কাজ করছিলাম তখন থেকেই তাঁকে চিনি ও জানি। সেই ৭০’র ১২ নভেম্বর ভয়াল জলোচ্ছাস উত্তর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশের আশির দশক। যখন মতিঝিল বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ষ্টাডিসে (বিআইডিএস) সিনিয়ার রিসার্চার হিসাবে তিনি কাজ করতেন। এক কক্ষে বসে পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিত সাদাসিধে হাসিমাখা ব্যক্তিটি কাজ করতেন। হ্যাঁ, তখনও বাবরী চুলই ছিল।

কিন্তু পার্থক্য হলো, তখন ছিল নিরেট কালো। আর এখন ধবধবে সাদা। কোন কালো রং বা মেহেদী লাগানোর মেকী গীরি নেই। প্রকৃতি এবং ব্যক্তিগতভাবেও চলনে বলনে সর্বক্ষেত্রে মৌলিকত্ব ঠিকই রেখে চলেছেন। আদ্যোপান্ত একইভাবে দেশে বিদেশে লিখালিখি, গবেষণা, প্রকাশনা ও বলাবলি কাজ করেই চলেছেন। মুক্ত স্বাধীন দেশের গোড়া থেকেই অদ্যাবধি তাঁকে দূরে কাছে কাজে পথচলায় দেখেছি জেনেছি বুঝেছি। বাচনে চলনে চিন্ত্তায় চেতনায় প্রায় ক্ষেত্রেই মিলেছে। এতে লাভবান হয়েছি বেশী এজন্য যে, তাঁর কর্ম-ভূমিকা আমার জন্য প্রত্যয়ন হিসেবেই আমি দেখেছি। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিতে বসেও তিনি আমার অনেক কাজে এক্সেস দিয়েছেন এবং বিভিন্ন পরিমন্ডলে এগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সমাজে পিছিয়ে পড়াদের পক্ষ নিয়ে সর্বদা উঁচ্চ কন্ঠ। তিনি হলেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।

চলার পরিক্রমায় অনেক অর্জনের পরও কার্যত সব কাজে সফলতায় যেতে পারেননি তিনি। কিছু নিয়ে বা দিয়ে বা পর্যবেক্ষক হিসেবেই চলতে হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা ছিল ‘রসদ’র এবং ‘অবস্থান’র। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর চেয়ারম্যান অবস্থানে, সরকার তাঁকে দেয়ায়, তাঁর দারিদ্র্য বিমোচনুূখী চিন্তার অনুশীলন ঘটান শুরু করলেন। এটা তাঁর জীবনকাল ইচ্ছা, আস্থা, দৃঢ়তা ও অদম্য সৎ সাহসের ব্যাপার ছিল। পল্লী কর্র্ম সহায়কে যোগদান করা না করা, কী ভাবে এগুবেন ইত্যাদি নিয়ে টুকটাক কথাবার্তার ২/১ জনের মধ্যে আমিও ভাগীদার ছিলাম। সত্যি কথা বলতে আমিও শংকিত ছিলাম। কেননা পিকেএসএফ-এ শুধু ঋণ নিয়ে যে কঠিন শিলা তৈরী হয়েছে তা রেখে বা ভেঙ্গে কিভাবে সামগ্রীকতায় সামষ্টিক করবেন তাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, ধীর পদচারণা, নিঃস্বার্থতা, নিরঅহমিকা, ধারাবাহিক চিন্তা চেতনা থেকে কোন সম্মুখ বা পশ্চাৎ বাঁধা তাঁকে ঠেকাতে পারেনি। কচ্ছপের মত মুখ বের বা ঢুকিয়ে নেয়ার ধান্ধাবাজদের শেষ পর্যন্ত চুপসেই যেতে হয়েছে।

অনুপ্রেরণাযোগ্য যে, তাঁর সহধর্মীনি সাদামাটা তীক্ষ্ণ স্বল্প ভাষী প্রফেসর ড. জাহেদা আহমদ সর্বদা আছেন ও তাঁর সঙ্গ দিয়ে থাকেন। পিকেএসএফ’র কিছু কর্মকর্তা, পার্টনার অর্গানাইজেশান এবং তৎকর্মীদের সাবলীল অংশগ্রহণ ছিল তাঁর জীবনব্রত বাস্তবায়নের অদম্য শক্তি। তাই পিকেএসএফ শুধু অর্থ লগ্নীময়ী ঋণ আদান প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানই নয় বরং অর্থ ভান্ডার সমৃদ্ধ রসদসহ দরিদ্র সকল শ্রেণীর ‘জন্য’ ও ‘সঙ্গে’ কসরৎকারী একটি মডেল প্রতিষ্ঠান।

এটি এমন একটি আস্থাবান সুখ্যাত প্রতিষ্ঠান যা এখন সবারই ভাবী। বিশেষ করে স্বপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলনকৃত ধারণা সম্প্রসারণের জন্য, শুধু অর্থ নয়, বুদ্ধি চিন্তা বিক্রীকারী প্রতিষ্ঠানও বটে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি, এডিবি এ সকল বৈষম্য সৃষ্টিকারী সেবা নামে মহাজন সম্প্রদায় থেকে সাবধান থাকতে হবে। যাতে আমরা আমাদের আমিত্ত-স্বাধীনতা তথা মুক্তির পাওয়া পথ ও পন্থা জনকেন্দ্রীক কাঠামো ইত্যাদিকে বলি না দেই। কেননা এখনও অনেক দূর এগুতে হবে। বৈষম্য ঠেকাতে বটমলাইনিংয়ে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার।

এ স-ব মহাজনেরা কৃপা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধার, লোভ লালসা, কনসালটেন্সি, কনসেশন, এজেন্সি দিয়ে, আমাদেরকে ভিন্নভাবে পরাভূত করে, সাহায্য-সহযোগীতার নামে, পরোক্ষভাবে সুকৌশলে শেকল পরিয়ে দিতে বিধিবদ্ধ। এঁরা এমন জায়গায় পৌঁছায়ে দিতে সিদ্ধহস্ত যে, যা কবির ভাষায় ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’। তাই কৌশলী হতে হবে আমাদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতাকে উঁচিয়ে রেখে নিজেদের রচিত পথকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা নিজের সম্পদে দেশ প্রেমিকতার উঁচুতায় এ সকল থাবাকারীদের তাক লাগান জবাব দিয়েছেন ‘পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করব’ ঘোষণা দিয়ে।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সমৃদ্ধতায় রাখার শুধু কাজীই নন বরং তিনি ঘটক, বর কনের পিতামাতা, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, পড়শী, উঁচু নীচু সমতল সবাইকে নিয়ে অধিকার, সাম্যতা ও ন্যায্যতার জন্য নিরলস ও নির্লোভভাবে কাজ করে যাওয়ার এক প্রকৃষ্ট ঝান্ডাবাহী দৃষ্টান্ত। তাঁর মানব কেন্দ্রীক সামগ্রিক উন্নয়নে যে সকল জ্যান্ত কর্মযজ্ঞ গুলো এখন দৃশ্যমান তম্মধ্যে ‘সমৃদ্ধি’, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মান; কিশোর-কিশোরী নৈতিকতা ও মূল্যবোধ; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন, পানি ও স্যানিটেশন, সংস্কৃতি উল্লেখযোগ্য।

আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। বাংলাদেশ একাডেমী ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (বার্ড), বগুড়া একাডেমি, মাঠের স্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিদদের অংশগ্রহণমূলক, জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসনের সমন্বয়ে স্থানীয় উদ্যোগ ও আছে সম্পদ ক খ গ ঘ শ্রেণীকৃত সারা দেশের ১২টি গ্রামের মূল্যায়ন চিত্র প্রকাশনার ‘সম্পাদকীয় মন্তব্য’ লিখে দেয়ার পরিষদ সদস্য সচিব হিসাবে অনুরোধ করেছিলাম। বিআইডিএস, ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন-নিপা-বর্তমানে পিএটিসি। (যখন লিখছি, পত্রিকায় দেখলাম ২৫ আগষ্ট ২০১৯ তারিখে, নিপার তৎকালীন মহাপরিচালক দেশ উন্নয়নে গ্রামীন নারীদের- প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণের প্রবক্তা, নীরব আরেকজন জ্ঞান তাপস মাটির মানুষ ড. শেখ মাকসুদ আলী ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। ‘স্যার ট্রেনিং পাইয়া আমার চোখ খুইল্যা গেছে’, সুযোগ পেলেই ট্রেনিং প্রাপ্ত তহুরার মনের গভীর উপলব্ধির কথাটি শুনাতেন -ড. শেখ মাকসুদ আলী।) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি প্রধানদেরকে নিয়ে সম্পাদনা পরিষদ গঠিত ছিল।

প্রশিকা এবং ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার (ভিইআরসি) যৌথ প্রকাশক ছিল। গ্রাম-দেশ উন্নয়নের পথ, পস্থা ও কৌশল অণ্বেষণের ৮৯ পৃষ্ঠার মূল্যায়ন পুস্তিকাটি ১৯৭৯ইং এ প্রকাশিত। অন্তর দিয়ে তিনি নিখুঁতভাবেই বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় পাদটিকাসহ ৪ পৃষ্ঠা সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। তা থেকে কয়েক লাইন তুলে দিলামঃ… ‘‘গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা পরিকল্পনাসমূহ জেলা পর্যায়ে সমন্বয় সাধিত হয়। এভাবে তা জাতীয় পরিকল্পনার সামিল হওয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশন পর্যন্ত পৌঁছে।

কার্যতঃ জাতীয় পরিকল্পনার যে প্রক্রিয়া উপরে প্রদর্শিত হয়েছে তা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অংশে স্বনির্ভর আন্দোলনের কাঠামোতে গ্রাম পরিকল্পনাসমূহ প্রণীত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম পরিকল্পনাগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে সমন্বিত হয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিকল্পনা থানা পর্যায়েও সমন্বিত হয়েছে।

একটি মাত্র ক্ষেত্রে যেমন, টাংগাইল জেলা পরিকল্পনাও প্রণীত হয়েছে…..। যে বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, যে সকল দিকগুলো অবজ্ঞাত ও অবহেলিত অথচ উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য অতীব জরুবী, সেগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আর্কষণ করবে।” কিউ. কে. আহমদ নামে খ্যাত তাঁর ধারাল যে ‘মূল্যায়ন সম্পাদকীয়’ তা আমি মূল পুস্তিকাটি পুন: পড়ে ‘পাগলের সু-খ মনে মনে’ উপভোগ করছি। যেন সে দিনের দূর দৃষ্টি সম্পন্ন তাঁর লিখাসমূহ আজ মানব কেন্দ্রীক গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টার জাতীয় পরিকল্পনায় প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।

সৎ চিন্তা ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব যে কল্যাণ পরিবর্তন আনতে পারে তার উদাহরণ সমৃদ্ধি বন্ধু ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও পিকেএসএফ এর বিরল সংস্কার খাত। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে তিনি সর্বোচ্চ ‘জাতীয় স্বাধীনতা পদক’ ২০১৯ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় এ প্রাপ্তিতে আরো কাজ করতে হবে বিবেচনায় আত্ম তৃপ্তিতে দৃঢ়। নির্লিপ্ত। কিন’ নীরব কর্ম সম্পাদনে বিশ্বাসী। একজন তরুণ-বয়স্বী মানব কেন্দ্রীক অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদই টেকসইতার লক্ষ্যে এক প্রজন্ম মেয়াদী বটম লাইনিং ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক স্বপ্ন প্যাকেজ’ (যা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত) বাস্তবায়নে সমৃদ্ধির বন্ধন ঘটাতে পারেন।

 

 

 

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, ডর্‌প এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী -২০১৩। nouman@dorpbd.org

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here