ফরহাদ খাদেম, ইবি সংবাদদাতা ::
নতুন উপাচার্যের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সংস্কার ভাবনা তুলে ধরেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) সমন্বয়ক এস এম সুইট।
সোমবার (৩০ সেপ্টম্বর) দুপুর সাড়ে ১২ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উপাচার্যের সাথে শিক্ষার্থীদের সংস্কার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতবিনিময় সভায় সভায় সমন্বয়ক পরিষদের পক্ষ থেকে এ ভাবনা তুলে ধরেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। পরে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এর পর জুলাই বিপ্লবে নিহত শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দোয়া মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আশরাফ উদ্দিন খান। সম্প্রতি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফী এবং বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ দুই হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে দীর্ঘ এক মাসেরও অধিক সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ থেকে ‘গুগল ডক’ ফরমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সংস্কার ভাবনা সংগ্রহ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ৪৬ টি দাবি উঠে আসে।
শিক্ষার্থীদের সংস্কার প্রস্তাবনা গুলো হলো-
ক) ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি:
১. ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া।
খ) শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও বিভাগ সংক্রান্ত:
২. শিক্ষাকার্যক্রম ও প্রশাসন পরিচালনায় লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এল এম এস) এর মত অত্যাধুনিক পদ্ধতি প্রচলন করা।
৩. সেশনজটের শিকার সকল বিভাগে সেশনজট নিরসনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া।
৪. শিক্ষার্থীদের একটি অভিন্ন পরিচয়পত্রের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলপ্রকার কার্যাবলী সম্পন্ন করা।
৫. প্রশাসনিক ভবনের সেবার মান দ্রুততম সময়ের ভিতরে আধুনিকীকরণ ও কাজের প্রতি অবহেলা নিরসন করার পাশাপাশি, অনলাইন পেমেন্ট প্রক্রিয়া সচল করা।
৬. শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনের ভিত্তিতে স্কলারশিপ নিশ্চিত করা।
৭. শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সিলেবাসে গবেষণা অন্তর্ভুক্তি এবং গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রতি বিভাগে মানসম্মত ইংরেজি শিক্ষা নিশ্চিত করা।
৮. বিভিন্ন বিভাগে বাস্তব ও কর্মসংস্থানমুখী কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা।
৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি সকল বিভাগের ক্লাস, পরীক্ষা ও রেজাল্ট একই সাথে নেওয়া।
১০. শিক্ষকদেরকে রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত ক্লাস নেওয়া বাধ্যতামূলক করা।
১১. পরীক্ষার ৭ দিন পূর্বেই টিউটোরিয়াল ও ক্লাস উপস্থিতির নম্বর নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া।
১২. পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রাখতে নীতি প্রণয়ন করা।
১৩. উন্নত দেশের ন্যায় শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকবৃন্দ গোপনীয়তার সাথে মূল্যায়িত হবেন এবং এই মূল্যায়ন ফলের ভিত্তিতে রেটিং প্রকাশ করা।
১৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়্।
১৫. শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করা।
গ) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও হল রিডিং রুম:
১৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সপ্তাহে সাতদিন রাত ১২ টা পর্যন্ত খোলা রেখে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং বই ইস্যু সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা। নিজস্ব বই নিয়ে অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিসর নিশ্চিত করার পাশাপাশি একই সাথে সব হলের রিডিং রুম আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা।
ঘ) নিপীড়কদের বিচার:
১৭. জুলাই বিপ্লবে বিভিন্ন ভাবে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও তাদের দোসরদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মামলা দায়ের করা।
১৮. গত পনেরো বছরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও তাদের দোসরদের নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
ঙ) আবাসন:
১৯. বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার রোডম্যাপ প্রকাশ ও বাস্তবায়নের পূর্ব পর্যন্ত মেধার ভিত্তিতে সিট প্রদান নিশ্চিত করা। আবাসিকতা নিশ্চিত করতে না পারলে নতুন কোন বিভাগ চালু করা যাবে না।
২০. আবাসন সংকট নিরসনে দ্রুততম সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আরো নতুন হল নির্মাণ করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য সব বিভাগে কমন রুমের সংখ্যা ও সুবিধা বৃদ্ধি করা।
২১. দীর্ঘদিন অবহেলার স্বীকার বেগম খালেদা জিয়া হলের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান সহ সকল সংস্কার কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা।
২২. হল প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের ক্যাম্পাসে অবস্থান ও নিয়মিত অফিস করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন করে গেস্টরুম ও গণরুম প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করতে হবে।
২৩. হল ডাইনিং এর পরিচ্ছন্নতা, খাবারের পুষ্টি ও গুনগত মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হবে।
চ) প্রযুক্তি সেবা:
২৪. সকল হলের ইন্টারনেট সুবিধার মান বৃদ্ধি সহ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ সর্বক্ষেত্রে মান সম্মত ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা।
২৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইফাই, আইসিটি সেবা ও ওয়েবসাইটের মান উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রত্যেক সেমিস্টারের ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা।
২৬. সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ইমেইল প্রদান করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্টেকহোল্ডারদের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা।
ছ) ক্যাম্পাস:
২৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া চালু করে খাবারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রদান করা।
২৮. নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অনুমোদন ব্যতীত সব ধরনের যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা।
২৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মান কাজ দ্রুততম সময়ের ভিতরে শেষ করা।
৩০. ক্যাম্পাসে বিনা অনুমতিতে বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। ক্যাম্পাসে কর্মরত বহিরাগত ব্যক্তিদের জন্য পৃথক আইডি কার্ডের ব্যবস্থা কর।।
৩১. ক্যাম্পাসকে মাদক এবং র্যাগিং মুক্ত করা।
৩২. ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত ডাস্টবিন নিশ্চিত এবং নোংরা আবর্জনা মুক্ত করে সবুজায়ন করা।
৩৩. ক্যাম্পাসে টয়লেট সমূহ রুটিন মাফিক পরিচ্ছন্ন করা। পরিষ্কার করার পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সই নেওয়া।
জ) স্বাস্থ্য-সেবা:
৩৪. দায়িত্বরত চিকিৎসকদের রুটিন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন ও দক্ষ কর্মচারী নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়ন ও হলে হলে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ ও ডিসপেনসারি স্থাপন করা। বিশেষায়িত ডাক্তারদের সপ্তাহের ৫ কার্য দিবসের অন্তত দুই দিন (দিনের বেলা) চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
ঝ) এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ:
৩৫. টিএসসিসিতে সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সচল রাখার প্রয়োজনে অফিস রুম বাদে সকল রুম খোলা রাখার ব্যবস্থা করা।
৩৬. বিশ্বমানের জনশক্তি তৈরি করতে শিক্ষাক্রম এর পাশাপাশি অন্যান্য কোর্স (যেমন: বেসিক কম্পিউটার, ফ্রিল্যান্সিং) চালু করা।
৩৭. কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ক্যাম্পাসে নিয়মিত জব ফেয়ার আয়োজন করা।
ঞ) ক্রীড়া ও শরীরচর্চা:
৩৮. জিমনেসিয়ামে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিশ্চিত এবং সপ্তাহে ৭ দিন ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য সিডিউল মোতাবেক খোলা রাখা।
৩৯. বাৎসরিক ক্রীড়া আয়োজন ও প্রত্যেক বিভাগকে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৪০. বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর ও লেক সংস্কার করা এবং সুইমিং পুল নির্মাণ নিশ্চিত করা।
ট) পরিবহন:
৪১. পরিবহন সেবার শৃঙ্খলা ও গুণগত পরিবর্তন করা। পরিবহনে বহিরাগতদের আরোহন পুরোপুরি বন্ধ করা।
৪২. পরিবহন সার্ভিসের জন্য আলাদা অ্যাপস তৈরি করতে হবে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপসের ভেতরে পরিবহনকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
ঠ) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সেবা:
৪৩. পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা এবং এই অফিসে ইতিপূর্বে শিক্ষার্থীদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।
ড) ক্লাসরুম ও ল্যাব সংক্রান্ত:
৪৪. প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম নিশ্চিত না করে নতুন বিভাগ চালু না করা এবং চালুকৃত বিভাগসমূহের জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নিশ্চিত করা।
৪৫. ল্যাব এবং রিচার্স সংক্রান্ত পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করা।
ঢ) শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব:
৪৬. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভাগ গুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও জবাবদিহি বৃদ্ধিতে প্রশাসনিক এবং একাডেমিক প্রতিটি সভায় শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, আমরা ক্যাম্পাসের যাবতীয় সমস্যা তুলে ধরেছি। আশা করি বর্তমান প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন। আমরা চাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা উচু করে দাড়াক।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার নিয়ে যে চিন্তা করেছিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের ভাবনা তুলে ধরে আমার সে কাজকে সহজ করে দিয়েছে। তাদের সকল দাবিই যৌক্তিক, আমি তাদের দাবি পূরনের লক্ষ্যে কাজ করে যাব।