ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিঃ
বিশ্বের অন্যান্য দেশে বীমা শিল্প অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের বীমা শিল্প অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এ পিছিয়ে থাকার পিছনে আমরা যারা প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। আশান্বিত হওয়ার বিষয় এই যে, সরকার কর্তৃক বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠিত হয়েছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর চেয়ারম্যান মহোদয় অত্যন- দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে বীমা শিল্পে বিদ্যমান সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে একে একে তা দূরীভূত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ট্যারিফ রেইট চেয়ে কম রেইটে ঝুঁকি গ্রহণ এবং প্রিমিয়াম গ্রহণ ব্যতিরেকে বীমা ডকুমেন্ট ইস্যু করার প্রবনতা রোধ/বন্ধ করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহন। (আইডিআরএ) এর গৃহীত এ পদক্ষেপ দুটি বাস-বায়নে বীমা কোম্পানী সমূহ এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) অত্যন- আন-রিকতার সাথে এগিয়ে এসেছে। এতে করে বীমা কোম্পানীসমূহ লাভজনক হচ্ছে এবং ক্রমশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
এটি সকলেরই জানা, বীমা শিল্প উন্নয়নে/প্রসারে বড় বাধা-বীমা ব্যবসায় অবৈধ কমিশন প্রদান। এ কমিশন বন্ধ করার জন্য পূর্বে বহুবার প্রয়াস নেয়া হয়েছিল-তা সফল হয়নি। এ কমিশন প্রাপক হলেন-অনেকই। এটি বন্ধ হওয়া আবশ্যক। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এ কমিশন প্রথা বন্ধ করার প্রয়াস নিয়েছে, আমাদের আন-রিক অভিনন্দন। নিঃসন্দেহে এটি একটি সূদুর প্রসারী পদক্ষেপ। কমিশন প্রথা বন্ধ করার এ মহতী প্রয়াস সফল হলে -তা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। বীমা শিল্প অত্যন- মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। বীমা কোম্পানীগুলি দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স এ এজেন্ট রয়েছে বাস-বে তাদের অসি-ত্ব নেই বললেই চলে। বাস-বে রয়েছে উন্নয়র অফিসার তথা ডেভোলপমেন্ট অফিসার তাদেরকে দিয়ে বীমা ব্যবসা সংগ্রহ করা হয়। তাদেরকে রেখেই বীমা ব্যবসা এগিয়ে নিতে হবে। বীমা আইনে কমশিন পাওয়ার অধিকারী হলেন বীমা এজেন্ট।
প্রতিটি বীমা কোম্পানীর ঢাকা এবং অন্যান্য বড় বড় শহরে শাখা অফিস রয়েছে। শাখায়-শাখা প্রধান, উন্নয়ন কর্মকর্তা রয়েছেন। অধিকাংশ বীমা কোম্পানী শাখা প্রধান ও উন্নয়ন কর্মকর্তাগনকে ব্যবসা আহরণের উপর কমিশন ভিত্তিক বেতন প্রদান করে থাকে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত (নন-লাইফ বীমাকারীর জন্য কমিশন ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা) খসড়া প্রবিধানমালা ২০১১ থেকে –
প্রতিভাত হয় যে, বীমা ব্যবসায় বীমা এজেন্টের পাশাপাশি ব্রোকার হাউজ থাকবে এবং ব্রোকার হাউজের বীমা এজেন্ট থেকে অধিক কমিশন পাওয়ার সুযোগ বিদ্যমান থাকবে। ৪(ক) এবং খ-তে বলা হয়েছে যে, একই পলিসির ক্ষেত্রে বীমা প্রতিনিধিকে প্রদেয় কমিশন বাদ যাইবে। এতে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি যে ব্রোকার হাউজ বীমা ব্যবসা সরাসরি গ্রহণ করতে পারবে কিনা? যদি সরাসরি বীমা ব্যবসা আহরন করতে পারে তাহলে বীমা ব্যবসা কেন্দ্রীভূত হবে ব্রোকার হাউজ-এ, বীমা এজেন্ট কোন বীমা ব্যবসা পাওয়ার সুযোগ থাকবে বলে মনে হয় না।
এ অবস’ায় শাখা-ইনচার্জ এবং শাখায় কর্মরত উন্নয়ন কর্মকর্তাগন যদি এজেন্ট লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়ে বীমা এজেন্ট হিসাবে কাজ করতে চান তাহলেও ব্রোকার হাউজের সুবিধা ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট থেকে অধিকতর হলে শাখা-ইনচার্জ এবং শাখা উন্নয়ন কর্মকর্তাগন বীমা ব্যবসা আহরন করার সুযোগ পাবার সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে হয় না।
মূল উদ্দেশ্য হলো অবৈধ কমিশন প্রথা বন্ধ করা। এ মূল উদ্দেশ্য বাস-বায়নের উপরই সর্বাত্মক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। কোম্পানীর শাখা প্রধান এবং উন্নয়ন কর্মকর্তাগনকে এজেন্ট লাইসেন্স প্রদান করে অবৈধ কমিশন প্রদান প্রথা বন্ধ করার প্রয়াস সফল করা সহজতর হবে। অন্যদিকে ব্রোকার হাউজ সৃজন করা হলে বীমা শিল্পে কর্মকান্ড অনেক জটিলতর হবে। সৃষ্টি হবে একটি শক্তিশালী মধ্যসত্ব ভোগী আমাদের এখানে বীমা ব্যবসা ট্রাফিক মেকার ভিত্তিক। এক্ষেত্রে ব্রোকার হাউজ এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু রয়েছে তা অনুধাবন করা প্রয়োজন। ব্রোকার হাউজ সৃষ্টি হলে ব্রোকার হাউজ এবং শাখা সমূহের মধ্যে অনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকবে। বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠি এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠি ব্রোকার হাউজ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ব্যবসার বীমা নিজেরা করার আগ্রহী হবেন। এতে বর্তমান কর্মরত শাখা প্রধান এবং বীমা উন্নয়ন কর্মকর্তাগন বীমা ব্যবসা হারাবেন। ফলশ্রুতি উন্নয়ন কর্মকর্তাগন বেকার হয়ে পড়বেন।
দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে বীমা শিল্প কর্মসংস’ান উন্নয়ন এ এক বড় ভূমিকা রেখে আসছে। কিন’ ব্রোকার হাউজ সৃষ্টি হলে কর্মসংস’ান উন্নয়ন এ অবদান অনেক নিম্নমূখী হবে। অধিকন- যে সকল উন্নয়ন কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন তাদের অনেকেই কর্মশূন্য হয়ে পড়বেন।
এখানে উল্ল্লেখ্য যে আইনে অনেক কিছু থাকে কিন’ সব আইন একত্রে বাস-বায়ন করা সব সময় সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রেও ব্রোকার হাউজ সৃজন থেকে বিরত থাকা যৌক্তিক হবে মূল উদ্দেশ্য অবৈধ কমিশন বন্ধের স্বার্থে। আমাদের অনুভবে থাকা প্রয়োজন যে পরিকল্পনা এবং নকশা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই কাজটি হুবহুব বাস-বায়ন করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না, কখনও কখনও শ্রেণীবিন্যাস এ কিছুটা পরিবর্তন করতে হয়। সহজভাবে যদি বলতে হয় তাহলে বলা যায় যে, বীমা কোম্পানীর শাখা সমূহকে বিদ্যমান অবস’ায় রেখে শাখা প্রধান এবং উন্নয়ন কর্মকর্তাগনের পদবী অক্ষুন রেখে তাদেরকে এজন্ট লাইসেন্স প্রদান পূর্বক বীমা ব্যবসা সংগ্রহ করার সুযোগ দেয়া হলে অবৈধ কমিশন প্রদান প্রথা বন্ধ করার প্রয়াস সার্থক হবে তা আশা করা যায়। অন্যদিকে যেখানে জীবন বীমা, ব্যাংক ও অন্যান্য ফাইনান্স ইনষ্টিটিউট এর ব্রোকার হাউজ এর কোন অসি-ত নেই সেখানে নতুন ধারণা ব্রোকার হাউজ বীমা কোম্পানীতে সৃজন করা হলে অবৈধ কমিশন বন্ধের প্রয়াস দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস’ হওয়ার সম্যক সম্ভাবনা থাকবে এবং বীমা শিল্প উন্নয়নের পথে এগিয়ে না গিয়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে দ্রুত এই আশংকা অত্যন- জোরালোভাবে এসে যায়।
তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে বহু বছরের পুরাতন একটি অবৈধ প্রথা কালক্রমে নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে। তাই এ অবৈধ কাজটি বন্ধ করা খুব সহজ কাজ নয়। বিষয়টি একজনের নয় বহুজনের। এর জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। যে কোন বৃহৎ কাজ শুরু করার পূর্বে প্রয়োজনীয় প্রস’ুতি নিতে হয়। ধরা যাক; একটি নির্বাচন করা হবে। তার জন্য পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ধরনের ব্যাপক প্রস’তি নিতে হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রস’তি নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বন্যার পানি বেধে রাখার জন্য বাঁধ দেয়া হলো-সে বাঁধ যদি টেকসই না হয়-অর্থাৎ তা যদি ভেঙ্গে যায়-তাহলে বাঁধ না থাকলে বন্যার পানি যা ক্ষতি করতো তার চেয়ে অনেকগুন বেশী ক্ষতি করে।
অবৈধ কমিশন প্রথা বন্ধ করার লক্ষ্যে যে কাজগুলি করা প্রয়োজন-তা হলোঃ
১। সংবাদপত্র, টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচারণা;
২। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ, শিল্প ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলিকে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে অবহিত করা;
৩। বীমা কোম্পানীর চেয়ারম্যান, ব্যবস’াপনা পরিচালক ও শাখা ব্যবস’াপকদের সাথে মাঝে মাঝে বৈঠক করে মত বিনিময় করা;
৪। প্রস’তির জন্য কিছু সময় নেয়া;
৫। সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কোন পাবলিক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বীমা ব্যবসা যাতে করতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা;
৬। বর্তমান বিদ্যমান ম্যানেজমেন্ট খরচ এর পরিমান যৌক্তিকবৃদ্ধিকরণ;
৭। কমিশন প্রথা বন্ধ করার ব্যাপারে বীমা কোম্পানীগুলিকে কতিপয় নিয়ম-কানুন প্রতিপালন করতে হবে। এসব নিয়ম-কানুন সম্বলিত একটি নীতিমালা কোড অব কন্ডাক্ট ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন প্রণয়ন করবেন। এ নীতিমালা কোম্পানীগুলিকে মেনে চলার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে;
৮। কমিশন প্রথা বন্ধ করতে যেয়ে কোন বীমা কোম্পানী যাতে ক্ষতি বা হয়রানির সমুক্ষীন না হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নীতিমালায়এরুপ একটি প্রভিশন রাখা যায় যে বর্তমানে যে বীমা কোম্পানী যে সব আগুন এবং মটর ব্যবসা অর্থলগ্নী করছে সে সব বীমা কোম্পানী আগামী ২-৩ সে সব বছরে যে সব আগুন এবং মটর ব্যবসায় অর্থলগ্নী করার সুযোগ পাবে। এক কোম্পানী অন্য কোম্পানীর বীমা ব্যবসা নিয়ে যাবার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না। অবৈধ কমিশন প্রথার মূলে হলো অনৈতিক প্রযোতিযোগীতা অর্থাৎ ব্যবসা আহরণের প্রতিযোগীতার জন্যই কমিশন বৃদ্ধি পায়। এ অনৈতিক প্রতিযোগীতা বন্ধ করার পথ খুঁজে সে পথে আমাদের অবশ্যই হাটতে হবে। উল্লেখ্য যে, ভডিট ফার্ম এবং রেটিং কোম্পানী এর কার্যক্রমের বিষয়ে এরূপ নিয়ম বিদ্যমান আছে যে কোন কোম্পানী কর্তৃক অডিট ফার্ম এবং রেটিং কোম্পনীকে কোন কাজে নিয়োজিত করা হলে তা ০৩(তিন) বছর পূর্বে যুক্তিযুক্ত কারণ ব্যতিত কোন পরিবর্তন করা যাবে না। বীমা ব্যবসার ক্ষেত্রে এরূপ নীতিমালা অনুসৃত হলে অনৈতিক প্রতিযোগিতা হ্রাস পাবে এবং অবৈধ কমিশন প্রদান প্রথা বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হবে।
পরিশেষে, বলতে চাই এ অবৈধ কমিশন প্রদান প্রথা একটি কালো ব্যাধি, বীমা শিল্প উন্নয়নের স্বার্থে এ বাধাকে অতিক্রম করতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকানি-ক প্রচেষ্টায়।