ইলিয়াছ হিমেল’র ছোটগল্প ‘মেয়েদের দেহ এত কষ্ট সইতে পারে না’ইলিয়াছ হিমেল :: 

বাবা, তুমি ঘুমাচ্ছো ?
-নারে মা, তোকে ছাড়া কখনো ঘুমিয়েছি, বল্ ?
-বাবা, আমার খুব ভয় করছে। চারদিকে শুন-শান নিরবতা। মাঝে মাঝে শিয়াল গুলো ডাকছে। মাটিগুলো খুব ঠান্ডা। আমি গত সাতদিন একটুও ঘুমাতে পারিনি। বাবা, আমাকে তোমার বুকে নিয়ে যাও না বাবা প্লিজ…।

-তুই কোথায় আছিস মা? কেমন আছিস? রোহিনি, তুই একবার কাছে আয় মা। তোকে আর কক্ষনো বকবোনা মা।
-বাবা, তোমাকে ছাড়া যে আমি এক মুহুর্তও এই মাটির ভিতর থাকতে পারছি না। বাবা, আমার খুব ভয় করছে।
-মা, তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলি কেন? খুব অভিমান এই বুড়ো বাপ-মার উপর?

-না বাবা, তোমাদেরকে আমি বড্ড ভালবাসি। তোমাদের জন্য হয়তো আমার মৃত্যুটি অনেক ভাল হয়েছে।কত না দু:শ্চিন্তা করতে আমার জন্য।কখন বাড়ী ফিরবো, পথে কোন সমস্যা হলো কিনা, কত দু:শ্চিন্তায় ছিলে তাইনা বাবা? আচ্ছা বাবা, আমি কি জোর করে এই পৃথীবিতে এসেছিলাম? কেন আমায় জম্ম দিলে বাবা? কেন এত অপমানিত হলে, বাবা ? মা কত কষ্ট করে আমাকে জম্ম দিয়েছে আমি সাতদিন আগে বুঝতে পেরেছি।

জানো বাবা, যখন ওরা তিনজন মিলে আমাকে নির্মাণাধীন একটি বাড়ীর ফ্লোরে এবড়ো থেবড়ো পাথরের উপর শুয়েছিলো, আমি মাগো করে চিৎকার করে উঠেছিলাম।অথচ, তুমি আর মা কোনদিন আমাকে ফ্লোরে পর্যন্ত শুতে দাওনি।মনে হচ্ছিলো, ধারালো পাথরগুলো যেন আমার পিঠে ঢুকে যাচ্ছিলো। চিৎকার করে তোমাকে একটু ডাকতে চেয়েছিলাম।কিন্তু, ওরা আমার গলা চেপে ধরলো।ব্যথায় আমার দু’চোখ বেয়ে গড়গড় করে পানি পড়তে লাগলো।

আচ্ছা বাবা, তুমি যে মুখে প্রতিদিন একটি করে চুমু না খেলে তোমার নাকি সারা দিন অশান্তি লাগতো, আমার মুখ নাকি এত মায়াবি।কিন্তু, আমার চিৎকার আর চোখের জল দেখে কি ওদের একটুও মায়া হলোনা ?

-রোহিনি, মা আমার।তুই কেন অভিমান করে এমন বলছিস মা? সেদিন তুই রাতে খেয়ে ঘুমাসনি বলে সারা রাত তোর মাকে কত বকেছি।কিন্তু এই সাতটা দিন কি খেয়েছিস মা ? তোকে ছাড়া আমাদের এই পৃথীবি, এই সম্পদ সব যে কিছু যে বিষাক্ত লাগছে।

-আমি জানি বাবা, তুমি আমায় ছাড়া একদিনও থাকতে পারবেনা।মা কে তুমি কষ্ট দিওনা বাবা।মা, তোমায় ভীষণ ভালবাসে। সেদিন বুঝলাম মায়ের কি কষ্টের ধন ছিলাম আমি। যখন দিলীপ দাদা জোর করে আমাকে ধর্ষণ করে তখন মনে হচ্ছিলো সমস্ত পৃথীবিটা আমার ব্যথায় বাবা বাবা বলে কেঁদে উঠলো।পিঠের নিছের শক্ত পাথরগুলো যখন আমার পিঠে ঢুকে যাচ্ছিলো তখন ঐ ধর্ষণের ব্যথার তুলনায় পাথরের আঘাতগুলোকে যতসামান্য আছড় মনে হচ্ছিলো।

ওরা কেন আমার সাথে এমন করলো বাবা ? আমি তো অজিতকে যখন দেখতাম তখনই ”দাদা নমস্কার” বলে সম্মান জানাতাম।আমার তো বড় দাদা নেই।অজিত, দিলিপ, পীযুষ এদেরকে আপন দাদার মত সম্মান করতাম।রাস্তায় যখন দেখতাম উনারা বসে গল্প করছে তখন মনে মনে ভাবতাম আমার যদি এরকম একটা দাদা থাকতো! দাদার সাথে সারা গ্রাম ঘুরতাম।দাদা আমাকে বকতো, আদর করতো। রাতে তুমি বকা দিলে দাদার কাছে বিচার দিতাম।কিন্তু আমার তো কোন দাদা নেই, তাই উনাদেরকেই দাদা ভেবে খুব আনন্দ পেতাম।

আচ্ছা,বাবা, আমার একটা দাদা থাকলে কি দাদাও আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতো ?

-রোহিনি, তুই এসব কি বলছিস মা ? তোকে ধর্ষণ করেছে? তোকে মেরে ফেলেছে? কে আমার এই সোনার প্রতিমার গায়ে আছড় দিলো ? আমার এই ১১ বছরের ছোট্র খুকিটিতো কারো ক্ষতি করেনি ।

-বাবা জানো, ওরা তিনজন পালাক্রমে আমাকে ধর্ষণ করছিলো। আমি ঠিক সেদিন বুঝলাম নারী পুরুষের মাঝে এরকম একটা সম্পর্ক হতে পারে। কত বোকা ছিলাম তাইনা বাবা ? যে মুখে তুমি আদর করে চুমু খেত সে মুখে ওরা কুকুরের মত কামড়েছে। যখন মাগো করে চিৎকার করলাম তখন দিলীপ দাদা আমার পেটে এত জোরে লাথ্থি মারলো যে, আমি বাবাগো করে শুধু একটা চিৎকার করলাম। মনে হচ্ছিলো সব ছিড়ে আমার নাড়ী ভূড়ী বের হয়ে আসবে।এরপর আর কিছুই মনে নেই।

-মা-রে, এত ব্যথা বুকে নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি ? আমাদেরকেও কষ্টের রক্ত নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তুই তোর প্রতিশোধ নিলি ?-না বাবা, ওভাবে বলোনা।কক্ষনো তোমাদের আমি হারাতে চাইনি। আমাকে যখন ওরা মারছিলো তখন শুধু তোমার মায়া ভরা মুখটা মনে পড়ছিলো। তোমার এত আদরের মেয়েটিকে কেউ মারতে পারবে এটা কোনদিন ভাবিনি বাবা। সকালে যখন আমার হুশ ফিরলো তখন আমি মৃত প্রায়। কাতরাতে কাতরাতে বললাম ”অজিত দা, তোমরা আমাকে মারছো কেন ? আমাকে আর মেরোনা, আমি আর নিতে পারছিনা ।

জানো বাবা, আমি খুব কাতর হয়ে বললাম। আমার শরীরে একটু শক্তিও পাচ্ছিলাম না। শুধু দেখলাম আমার পায়জামাটা রক্তে লাল হয়ে আছে।এত মায়া ভরা গলায় অজিত দার কাছে আকুতি করলাম ”দাদা, আমাকে এক গ্লাস পানি দাওনা। আমি দম নিতে পারছি না। ভাবলাম, হয়তো আমার প্রতি উনাদের একটু করুণা হবে। পৃথীবির কোন প্রাণী আমার ঐ আকুতি ভরা ডাক শুনলে সাড়া না দিয়ে পারতো না। কিন্তু ওরা আমার দিকে তাকিয়ে কটকট করে হেসে উঠলো। আচ্ছা বাবা, পুরুষরা কি মৃত লাশকেও ধর্ষণ করতে পারে ?

ইলিয়াছ হিমেল’র ছোটগল্প ‘মেয়েদের দেহ এত কষ্ট সইতে পারে না’-আমিও তো পুরুষ ছিলাম রোহিনী ! এই বাবাটির বুকের ভিতর কি তুই শান্তির নীড় খুঁজে পাসনি ?

– কেন অমন বলছো বাবা? এই পৃথীবির সবচেয়ে নিরাপদ বাসাটি ছিল তোমার বুক।কিন্তু ওরা একবারও ভাবলোনা আমাকে কষ্ট দিলে যে আমার এই বাবাটিও বাঁচবেনা।হয়তো আমি কোন অন্যায় করেছিলাম তাই আমাকে দাদারা এভাবে শাস্তি দিলো।কিন্তু তোমাকে আর মাকে কেন এভাবে কাঁদিয়ে গেল ওরা ?

-তোর মা তোর ছবিটি বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে আর বলছে ”মা, তুই আমার বুকে ফিরে আয়।আর কক্ষনো তোকে ধমক দিবোনা”।তোর মাকে একটু দেখা দিয়ে যা মা আমার ।বাবার অন্যায়ের শাস্তি তোর মাকে দিসনা।

-জানো বাবা, আমার আকুতি শুণে তুমি কাঁদছো আর ওরা খিলখিল করে হাসছিলো।পীযুষ আমার গালে এত জোড়ে এক চড় দিলো মনে হলো আমার এই পৃথীবিটা ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।অথচ, ক্লাস সিক্সে একদিন স্যার আমাকে ধমক দিয়েছিলো আর আমি কেঁদে কেঁদে বাড়ী যাওয়ার পর তুমি স্কুলে কি এলাহী কান্ডটি না ঘটিয়েছিলে।

সেদিন বুঝেছিলাম, আমাকে ছাড়া তুমি বাঁচতে-ই পারবেনা।ওরা কি একবারও ভাবেনি আমি শুধু একটা মেয়ে নয়, একজন পিতার সবচেয়ে ভালবাসার ধন, একজন মায়ের জরায়ু ছেড়া খুব কষ্টের নাড়ী ছেড়া ধন ?

বাবা, বিশ্বাস করো, আমি দাদাদেরকে কিচ্ছু করিনি। প্রাইভেট পড়ার জন্য যাচ্ছিলাম আমাদের দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে। দেখলাম, দিলিপ, পীযুষ আর অজিত দাদা দাড়িয়ে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে।আমি সামনে দেখে আদাব দিলাম। দিলিপ দাদা বলল ”রোহিনি, তোর সাথে একটু কথা আছে।একটু ঐ দিকে চল। কে জানতো তারা আমাকে এত কষ্ট দিবে। আমি তো প্রতিটি পুরুষকে আমার বাবার মত বিশ্বস্ত আর নিরাপদ মনে করতাম। মল্লিকাদের নির্মাণাধীন বাড়ীতে নিয়ে অজিত আমার গলায় ছুরি ধরে বলল ”আওয়াজ করলে জবাই করে দিবো”। আমি ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলাম। তারপর ওরা আমার দু’হাত বাঁধে। যখন গামছা দিয়ে আমার মুখটা বাধছিলো তখন টপটপ করে চোখের পানি পড়ছিলো। একটা জোরে চিৎকারও করতে পারলামনা।বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত ওরা আমাকে নির্যাতন করেছে।

জানো বাবা, ওরা আমাকে খুব মেরেছে। এতটুকু একটা মেয়ের বুকে তিনটা পশু হায়েনার মত কামড়েছে।বাবা গো, কেন আমায় জম্ম দিলে একবার বল ? যখন বয়স দশ হলো, স্তনটা হালকা ফুটে উঠতে লাগলো । তখন নিজেকে নিজের কাছেই ব্যতিক্রম এক সুন্দরী মনে হতে লাগলো।কিন্তু একবারও ভাবিনি সৃষ্টিকর্তার এই অপরুপ দান আমাকে এভাবে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। আমি তো সৃষ্টিকর্তাকে বলিনি আমাকে মেয়ে বানাও ?  তবে তোমরা সবাই মিলে কেন আমাকে এই পৃথীবিতে আনলে আর এত কষ্ট দিলে বাবা ?

রোহিনি হুহু করে কাঁদতে থাকে ।তখন রোহিনির বাবা ”মা মা” করে রোহিনিকে ধরতে গিয়ে দেখে রোহিনির বুক ছিড়ে রক্ত ঝরছে। আর রোহিনি বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলছে ”বাবা, তোমাদের ছেড়ে একদম চলে যাচ্ছি। কখনো আর তোমাদের এই খুকীটিকে ছুঁতে পারবেনা। রোহিনির যে মসৃণ দেহটাকে এত যত্ন করতে সেখানে নারীত্বের কলংক ছিল কখনো বুঝিনি আগে। সেদিন বুঝলাম, নারীদেকে ধর্ষণ করলেই শুধু সুখ আসে না।পুরুষের চাহিদা অনেক তীব্র।অনেক হিংশ্র।

আচ্ছা বাবা, ওরা তো আমাকে ছেড়ে দিলেও পারতো। কত করে অজিত দা-র পা ধরেছি। কেঁদে কেঁদে বলেছি ”দাদা, আমাকে ছেড়ে দাও, আর কক্ষনো এই মেয়েটিকে তোমাদের গ্রামে দেখবেনা”। দাদা, আমাকে একটু বাঁচতে দাও। আমার কান্না দেখে পীযুষ একটা চাকু মারলো আমার বুকে। গড়গড় করে তোমার প্রিয় রোহিনীর বুক ছিড়ে রক্ত গড়াতে লাগলো।

জানো বাবা, ইচ্ছে হয়েছিলো যদি এই কষ্টের মুহুর্তেও একবার তোমার গলাটা জড়িয়ে ধরতে পারতাম তাহলে পৃথীবির সকল কষ্ট এক নিমিষেই ভুলে থাকতে পারতাম। কারন, আমার বাবার মত এত মায়াবী বাবা আর কে আছে বল ? কিন্তু ওরা তোমার মুখটা কল্পনাও করতে দিলনা। বুক ছিড়ে আমার কলিজা আর ফুসফুস ছিড়ে বের করে আনলো। তখন শুধু অজিত দাদার পায়ে হাত রেখে বলেছিলাম ”দাদা, কেন এত কষ্ট দিলে?”

আচ্ছা বাবা, মেয়েদের কলিজা, ফুসফুসও কি পুরুষের খাদ্য ? তুমিও কি বড় হলে আমাকে এত কষ্ট দিতে ?

রোহিনীর বাবা ঘুমের ঘোরে ”রোহিনি” বলে একটা বুক ফাঁটা আর্তনাদ করে চিরতরে রোহিনীকে বুকে জড়িয়ে নিলো। প্রিয় কন্যার সাথে যোগ দিলো তার প্রিয় বাবা। পৃথীবিতে যোগ হলো আরো একটি নির্মমতা। রোহিনি রক্তাক্ত দেহ নিয়ে শুধু বলল ”অজিত দা, আর কাউকে এত কষ্ট দিয়ে মেরোনা। মেয়েদের দেহ এত কষ্ট সইতে পারেনা”।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজ কল্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: himelsw10@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here