আ হ ম ফয়সল, বার্তা সম্পাদক– ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম
২০১১ সালটি নারীদের জন্য যেমনি শোষন, বঞ্চনা, হত্যা, নির্যাতনের বছর হিসেবে কেঁটেছে তেমনি সাফল্যের অনেক বার্তাও বহন করে নিয়ে এসছে তারা। ব্যর্থতা ও সাফল্যগুলোকে এক করে নয়, নতুন দিনের জয়গানে, নতুনের আহবানে, ২০১২ সালের আগামী দিনগুলো হয়ে উঠবে সকলের জন্য আনন্দময়। নতুন বছরে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরিকরণে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকেও এগিয়ে আসতে হবে- এই আহবান সমাজের বিশিষ্ট নারী জনদের। নতুন বছরে নারী উন্নয়নের প্রত্যাশার খবর জানতে দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নারীর মূখমুখী হয়েছে ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম। তাদের ভাবনাগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে ধরা হবে।
রোকেয়া রুমী, তিনি বলেন-
‘ক্যান্সার নামক মরণ ব্যাধী শরীরে বাসা বেধেছে। শুধুমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত হলেই মানুষ মরে যায় না। মৃত্যু সবার জন্য অনিবার্য। মনের মধ্যে শত ব্যাথা ও যন্ত্রণা চাপা দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি কাজের মধ্যে। এখন কাজই আমার সুখ, কাজই আমার দুখ। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলাফেরা , খাওয়া দাওয়া, ঔষধ সেবন করছি। আমি এখন সুস’্য সবল, অন্য সকলের মতই একজন’। এ ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন স্তন ক্যান্সার আক্রানত যোদ্ধা রোকেয়া রুমি।
এখনও নানামূখী পেশার সঙ্গে যুক্ত রোকেয়া রুমী। নিজেকে একজন ক্যান্সার প্রতিরোধ যোদ্ধা মনে করে অন্য আট-দশ জনের এ ঘাতক প্রতিরোধে এখন তিনি নিজেই গত বছর থেকে (২০১১) কাজ শুরু করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘উইম্যান ক্যান্সার সাপের্ট প্রজেক্ট’। এ প্রকল্পের আওতায় তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের পরামর্শ, সেবা ও সহায়তার কাজগুলো করছেন। আক্রান্ত নারীদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পড়তে নিজের কর্মব্যস্তা ও নিয়ম মাপিক চলার উদাহরণটি বর্ণনা করে তাদের পাশে দাড়াচ্ছেন রোকেয়া রুমি। তিনি বলেন ‘প্রতিরোধের মাধ্যমে ক্যান্সারের মত মরণ ফাঁদকে জয় করা সম্ভব। ক্যান্সার কোন ছোয়াছে রোগ নয়। এমনকি সূচনায় এ রোগ নির্ণয় করতে পারলে অনেক ক্যান্সার ভালো করা যায়, তার জন্য প্রয়োজন দৃড় মনোবল’।
রোকেয়া রুমী পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি ইডেন কলেজ থেকে অনার্সসহ এমএসসি পাশ করে ২০০২ সালে এমবিএ পাশ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করেই শুরু হয় তার শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মজীবন। প্রথমে বুয়েট ক্যাম্পাসে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে তিনি নর্দান ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত হয়ে দীর্ঘ ৫ বছর সেখানে সহকারী পরিচালকের দ্ধায়িত্ব পালন করেন। তখন থেকেই নিজে কিছু একটা করার ভাবনা কাজ করতো রোকেয়া রুমীর মধ্যে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে লালমাটিয়া এলাকায় নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন ইনিষ্টিটিউট অব বিজনেস এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইএবিআইটি) নামে একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার। এ বছরই তিনি জগন্যাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলামকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্দ হন। বর্তমানে তার স্বামী শিক্ষা ক্যাডারে নোয়াখালী কলেজে কর্মরত রয়েছেন।
কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি রোকেয়া রুমী সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্নকে বাস্তব রূপদিতে পরবর্তী বছর ২০০৬ সালে ‘এডুকেশন ফর হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট (ইএইচআরডি) নামে একটি বেসরকারী সেচ্ছাসেবী সংগঠন (এনজিও) গঠে তুলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষা ও স্বাস’্যসেবা এখন বানিজ্যিক বিষয়। সকলের জন্য এ সেবা চিন্তা করতেই ২০০৬ সালে বাবর রোডে ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ ও গ্রামের বাড়ি সাতক্ষিরার সদর উপজেলায় দাদার নামে আফাজ উদ্দিন মেমরিয়াল স্বাস’্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করি। যেখানে এখন একজন ডাক্তার কর্মরত রয়েছেন’। বর্তমানে রোকেয়া রুমী ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল কলেজের পিন্সিপালে দ্ধায়িত্ব পালন করছেন।
শত ব্যস্ততার মাঝে ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারী জানতে পরেন তার শরীরে স্তন ক্যান্সার বাসা বেধেছে। হাল ছেড়ে দেননি। ঢাকাতেই নিয়মিত ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হয়েছেন। ৬টি কেমো থেরাপি নিতে হয়েছে রোকেয়া রুমীকে। যার অর্থের যোগান দিতে হয়েছে একমাত্র ছোট ভাই বদরুল মিল্লাত ও এক মামাকে। পাশাপাশি মা-বাবার নিবিড় পরিচর্যা তাকে সুস’্য হতে সহায়তা করেছে।
অসুস’তার খবর জানার পর থেকে স্বামী-শাশুড়ির সহযোগীতার কোন কমতি পেয়েছেন কিনা জনাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনকার স্বামীরা আগের মত সোহাগী না। এখন সবাই যান্ত্রীক হয়ে গেছে। আমার স্বামী কর্মক্ষেত্রে দূরে আছে। নিয়মিত পাশে স্বামী থাকতে হবে ফিল করি না। প্রয়োজন অনুযায়ী স্বামী, শাশুড়ি খোজ খবর নিচ্ছেন। নিজেকে বাঁচতে হবে তাই, নিজের চলাটা নিজেই ঠিক করি। এখন আমি নিজেই নিজের গার্ডিয়ানের দ্ধায়িত্ব পালন করছি।
এত ব্যস্তার মাঝেও রোকেয়া রুমী নিজ গ্রামে ও ঢাকার কয়েকটি এলাকায় দরিদ্র কয়েকজন নারীর মধ্যে শেলাই মেশিন কিনে দিয়েছেন হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরী করে সাবলম্বী হবার জন্য। তাদের তৈরীকৃত পন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেন। বিক্রয়মূল্যের অধিকায়শ অর্থই তিনি প্রস’কারীর হাতে তুলে দেন। এ ছাড়া নিজের স্কুলের ২০ জন দরিদ্র ছাত্রকে বিনামূল্যে তিনি নিয়মিত ভাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস’া অব্যাহত রেখেছেন।
ক্যান্সার যোদ্ধা রোকেয়া রুমী সমপ্রতি নিজের নির্দেশনায় তৈরী করেছেন ‘মুক্তির অন্বেষনে’ নামে ২৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারী। যেখাতে তিনি নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত লক্ষণ, প্রতিকারের উপায় তুলে ধরেছেন। দেশের নারীদের ক্যান্সার বিষয়ে সচেতন করতেই তিনি এ উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। যেটি আসছে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর প্রদর্শণ করা হবে। তিনি এই ডকুমেন্টারীটি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স’ানে প্রদর্শণের ব্যবস’া করবেন। যার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধে নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরী হবে। এতসব ব্যস্ততার মাঝেও রেকেয়া রুমী ‘ক্যান্সার ও আমি’ শিরোনামে একটি বই লিখে তা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি সম্প্রতি তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস’াপনা একাডেমীর ৯৪তম প্রশিক্ষণ কোর্সও শেষ করেছেন।
রোকেয়া রুমীর সব কাজই জনক্যাণকর। এতসব কাজের অর্থের যোগান কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারী, বেসরকারী এমনকি ব্যাক্তি পর্যায় থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে আমি এ ধরণের কাজগুলো করে থাকি। সেবামূলক কাজগুলো করার জন্য আমার আরও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এখন তিনি তার হতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তর করার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন ছয় বছরের এক মাত্র মেয়ে ফাবিহা যাহা্রা প্রিয়মীকে সাথে নিয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত রেগীদের জন্য সারা জীবন কাজ করে যাবার।