২০১১ সালটি নারীদের জন্য যেমনি শোষন, বঞ্চনা, হত্যা, নির্যাতনের বছর হিসেবে কেঁটেছে তেমনি সাফল্যের অনেক বার্তাও বহন করে নিয়ে এসছে তারা। ব্যর্থতা ও সাফল্যগুলোকে এক করে নয়, নতুন দিনের জয়গানে, নতুনের আহবানে, ২০১২ সালের আগামী দিনগুলো হয়ে উঠবে সকলের জন্য আনন্দময়। নতুন বছরে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরিকরণে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকেও এগিয়ে আসতে হবে- এই আহবান ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ এর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালনকারী পারভীন মাহমুদের। সমপ্রতি ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম এর মূখামূখী হয়েছেন আমাদের দেশে ২০১১ সালের সফল নারী পারভীন মাহমুদ। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম এর বার্তা সম্পাদক- আ হ ম ফয়সল
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ
তিনি বলেন,
আমাদের দেশে নারীদের অর্জন আছে অনেক। নারীর ক্ষসমতায়নে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এক্ষেত্রে একটি মডেল হতে পারে। অপরদিকে দেশে এখনও অনেক নারী নির্যাতানের ঘটনা ঘটছে। এ জন্য সরকার নীতিমালা বা আইন করে কিছু করতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না, আমরা সর্ব ক্ষেত্রে নারীকে সম্মান দেখাতে না পারবো? এক কথায় সকলের মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব-
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ২০১১ সালে দেশের একজন সফল নারী পারভীন মাহমুদ। পরিতৃপ্তির সাথে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ এর প্রথম নারী প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছেন বলে তিনি মনে করেন। বিদায়ী বছরের শেষের দিকে তিনি এ দ্বায়িত্ব শেষ করলেও তিনিই ছিলেন ২০১১ সালে সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব একাউন্টসের (সাফা) পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, পাশাপাশি সাফা উইমেনস ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
পারভীন মাহমুদের জন্ম ও বেড়ে উঠা চট্টগ্রামে। বাবা লুৎফর রহমান পেশায় ছিলেন একজন আয়কর উপদেষ্ঠা, মা পরান রহমান একজন সফল উন্নয়ন সংগঠক হিসেবে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। চার বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। চট্টগ্রাম হিলসাইড স্কুল (এখন নেই) থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে অর্পনা চরণ গার্স হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে এইচএসসি পাশ করেন।
এইচএসসি পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় লন্ডন প্রবাসী শিক্ষক আনিসুল ইসলামের সাথে। তখন তাকেও পাড়ি জমাতে হয় সেখানে। নিজের আগ্রহ আর স্বামীর প্রেরণায় আবার সেখানে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। লন্ডনে তিনি ‘এ’ এবং ‘ও’ লেবেল শেষ করেন। ছোট বেলা থেকেই বাবার আগ্রহের পাশাপাশি নিজেরও ইচ্ছে ছিল একাউন্টিং বিষয়ে লেখা পড়া করার। লন্ডনেই সিএ’র একটি পার্ট শেষ করেন। পরবর্তীতে শাশুড়ি অসুস’ হয়ে পড়লে তিনি ১৯৭৭ সালে নিজদেশে চলে আসেন। একদিকে নিজের দুই সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা, অন্যদিকে শাশুড়ির সেবাযত্ন, এ ভাবে কেঁটেযায় ৭টি বছর।
এরই মধ্যে পারভীন মাহমুদের স্বামীও দেশে চলে অসেন। স্বামী দেশে আসার পর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন শুরু করেন। পারিবারিক ব্যস্ততা বেড়েগেলেও স্বামীর পূর্ণসমর্থন ও আগ্রহে পূণরায় এসএফ আহমেদ এন্ড কোম্পানীতে সিএ পড়া শুরু করেন।
পারভীন মাহমুদ বলেন, ‘নিজেও পড়েছি, সন্তানদেরকেও পড়িয়েছি। মন্ত্রী স্বামী থাকার পরও কোদিন স্বামীর সাথে বিদেশ ঘুরিনি। ১৯৯১ সালে সিএ পাশ করি। কোন তদবিরে নয়, নিজের যোগ্যতায় কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র অতিক্রম করেছি। প্রথম কাজ শুরু করি ব্র্যাকে। কয়েকমাস সেখানে কাজ করার পর সিডাতে সাড়ে ৩ বছর কাজ করি। সেখান থেকে ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসেবে একশান এইডে যোগদান করি। একশান এইড তখন ২০টি দেশে কাজ করতো, ২০টি দেশের মধ্যে আমি একমাত্র নারী ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলার ছিলাম।
সর্বশেষ পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ এ দীর্ঘ ১১ বছর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। এখানে কাজ করে সাধারণ মানুষকে কাছে থেকে দেখার বা জানার সুযোগ পেয়েছি। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু ভূমিকা রাখছে তা উপলব্ধি করেছি। পেশাকে দেশ সেবা ও নেশা হিসেবে নিয়ে এখানে কাজ করেছি। এখানে কাজ করে যতটুকু দেখেছি, জীবনের মান উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ একটি টুল্স সিসেবে ভূমিকা রাখছে। পরিবারে নারীরা ঋণের টাকাটা পুরুষের হাতে তুলে দিতে পাচ্ছে বলেও তার মর্যাদাটা বেড়েছে।
পারভীন মাহমুদ বলেন- ঋণ দিয়ে অতিদরিদ্রদের দারিদ্র বিমোচন হবেনা। তাদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় এনে দীর্ঘমেয়াদী টেকশই উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্বে থাকাকালীন অনেক সম্মান পেয়েছি, বিদেশের মাটিতেও প্রতি মুহুর্তে এ পদের মূল্যায়ন ফিল করেছি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ক্ষাতকে কার্যকরি করতে সরকার এনজিওগুলোর সাথে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারে। নারীকে উন্ননের মূল শ্রতধারায় আনতে হলে সামগ্রীক উন্নয়নে মনিটরিং ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিবে। নারীকে সম্মান দিতে হবে। পরিবারে এখন নৈতিক শিক্ষা কমে গেছে, যা এখন খুবই প্রয়োজন। স্কুল কলেজে মেয়েদের লেখাপড়া অবৈতনীক হলেও তাদের অনেক খরচ অছে, আমি মনে করি পরীক্ষার ফি ছাড়াও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট খরচের ভাড় সরকার বহন করা উচিত। তাহলে বিভিন্ন শ্রেণীতে মেয়েদের ঝড়ে পড়ার প্রবণতা হার কমে যাবে। মেয়েদেরকে কারীগরি শিক্ষার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
পাভীন মাহমুদ কর্মজীবনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। বর্তমানে তার বড় মেয়ে জেরীন মাহমুদ হোসেন বিদেশ থেকে সিএ কোর্স শেষ করে স্বামী সংসারের পাশাপাশি ঢাকায় একটি পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত রয়েছেন। ছেলে শামস্ মাহমুদ বিদেশ থেকে এলএলএম শেষ করে এখন পারিবারিক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি এখন নতুন বছরে স্বপ্ন দেখেন নানী অথবা দাদী হবার।
পরভীন মাহমুদ নতুন বছরের প্রথম মাসটি কিছুটা অবসরে কাটলেও তার পরথেকেই নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ শুরু করবেন। তিনি বলেন, ‘যে অবস’নেই থাকিনা কেন নিজেকে কাজে লাগতে চাই অন্যের জন্য’। শিক্ষা-ধীক্ষায় একজন হিসেবের জগতের মানুষ হলেও ‘নারী উন্নয়নই নিজ জীবনের ব্রত’ হিসেবে মনে করেন পারভীন মাহমুদ।