সোনার ব্যবসার লোভ দেখিয়ে দেশের ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানী ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ লিমিটেড। এর মধ্যে প্রায় ১৭শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তিন বিদেশী ও ৫ দেশী প্রতারক এই বিপুল পরিমান অর্থের মালিক বনে গেছে। তিন বিদেশীর মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ড. আচারিয়ার মাধ্যমে ইউনিপে টু ইউ’র যাত্রা শুরু হয়। তাকে সহযোগীতা করেন সরকারের ক’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ কাজে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশেও এসেছেন। তিনি ছাড়া বাকি দুই বিদেশীর দুজনই হলেন মালয়েশিয়ার নাগরিক। আর বর্তমানে বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরৎ পাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলছে বিনিয়োগকারীরা। যেভাবে ইউনিপে টু ইউ’র আত্মপ্রকাশ : ইউনিপের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ‘বিনিয়োগকারীদের টাকা ১০মাসে দ্বিগুণ হয়’ এই সোগান নিয়ে ২০০৯সালের ১১অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। কীভাবে অল্প সময়ের মধ্যে এই বিপুল পরিমান লাভ দেয়া সম্ভব-সে সম্পর্কে ইউনিপে প্রচার করে তারা বিদেশে খনি থেকে কাঁচা সোনা কিনে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিক্রি করে। বিপুল পরিমান সোনা বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত আছে। এজন্য তাদের লাভ আকাশচুম্বী। এজন্য তারা ১০মাসে গ্রাহকের লাভের বিপরীতে দ্বিগুণ অর্থ দিতে পারছে। তাদের এ প্রচারে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সহজে আকৃষ্ট হয়। প্রথমে তাদের কার্যক্রম ঢাকায় শুরু হয়। এরপর চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তাদের পুরো কার্যক্রম চলে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে-যা ওয়েব ঠিকানার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আড়াই হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে ইউনিপে ঃ ইউনিপে টু ইউ’র এই লোভনীয় প্রচারে সাড়া দিয়ে সারাদেশ থেকে ৬ লাখ গ্রাহক তাদের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এমএলএম ব্যবসার বেঁধ দেয়া নিয়ম অনুযায়ী সবাই অ্যাকাউন্ট খুলে গ্রাহক হন। ১২০অথবা ৬৫ডলার বিনিয়োগ করে যে কেউ গ্রাহক হতে পারেন। এ হিসেবে গড়ে ১০০ডলার করে গ্রাহক প্রতি ধরলে ৪২০কোটি টাকা (ইউনিপে প্রতি ডলার ৭০টাকা মূল্যমান ধরে) আইডি চার্জ সংগ্রহ করে তারা। ৬লাখ আইডিধারীর মধ্যে অনত্মত ২লাখ গ্রাহক ইউনিপেতে ট্রেড (টাকা খাটায়) করে। এই ২ লাখের মধ্যে বেশিরভাগ  গ্রাহক লাখের ওপর টাকা বিনিয়োগ করেন। গড়ে লাখ টাকা গ্রাহকপ্রতি বিনিয়োগ ধরলে ২হাজার কোটি টাকারও বেশি আমানত সংগ্রহ হয় তাদের। দেশি-বিদেশিরা জড়িত ঃ এমএলএম কোম্পানির তৈরি করা রীতি অনুযায়ী প্রথমে একজনকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। পরে তার রেফারেন্সে একে একে অ্যাকাউন্ট (সেন্টার) খুলতে থাকেন গ্রাহকরা। সে হিসেবে ইউনিপে টু ইউ’র প্রথম সেন্টার করেন ভারতীয় নাগরিক ডা. আচারিয়া। অর্থাৎ তার হাত ধরে বাংলাদেশে ইউনিপের যাত্রা শুরু হয়। তিনি এ কাজে একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন। পরে তিনি স্থানীয় এজেন্ট ও সহযোগীদের সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারে আলোচনা করেন। সরকারের ক’জন প্রভাবশালী ব্যক্তিও তাকে সহযোগিতা করেন। ডা. আচারিয়ার পর মালয়েশিয়ান নাগরিক মাসুদুর রহমান ও মোগানদার গমগম জেমস দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হন। তারা ১৫টি করে সেন্টারের মালিক থাকেন। বাংলাদেশের এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হন খুলনার শহীদুজ্জামান শাহীন। তার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ২৬টি। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন মাদারীপুরের মুনতাসির হোসেন ইমন, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামালপুরের আবু তাহের, অর্থ পরিচালক খুলনার আবুল কালাম আজাদ ও জেনারেল ম্যানেজার নোয়াখালীর জামশেদুর রহমান। এদের মধ্যে বিদেশি ৩জন তাদের অ্যাকাউন্টের বিপরীতে দৈনিক প্রত্যেকে গড়ে ৩০লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লাভ পেয়েছেন। এ হিসেবে গত ১৮মাসে তারা এদেশ থেকে ৪৮৬কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চেয়ারম্যান খুলনার শহীদুজ্জামান শাহীন একাই লাভ পেয়েছেন প্রায় ৩০০কোটি টাকা। অন্যরা শতকোটি টাকার কাছাকাছি লাভ পান। বর্তমান অবস্থা : অদৃশ্য বস্তু দেখিয়ে সহজ-সরল গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে পড়ে। তারা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইউনিপেতে বিনিয়োগ না করার জন্য গ্রাহকদের সতর্ক করে দেয় এবং কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে যেগুলোতে ৪১১কোটি টাকা আছে। এছাড়া রাজধানীর ধানমন্ডিতে ১২কোটি টাকা দিয়ে ২শতক জমির ওপর নির্মিত একটি ভবন রয়েছে। রামুতে রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের জন্য জমি কেনা হয়েছে। এর বাইরে গ্রাহকদের ৩০০কোটি টাকার মতো রিবেট দিয়েছে তারা। বাকি প্রায় ১৭শ’কোটি টাকা দেশি-বিদেশি চক্র বাটোয়ারা করে নিয়েছে। অধিকাংশ টাকাই তারা বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছে। সব পরিচালকই পালিয়ে রয়েছেন। ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠান কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। গ্রাহকদের করা ২০টির মতো মামলার কারণে তাদের কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন, কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চেয়ারম্যানের বক্তব্য : ইউনিপে টু ইউ’র চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান শাহীন মোবাইল ফোনে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান ঠিক পথেই এগুচ্ছিল। রাবার ইন্ডাস্ট্রি, মোটর সাইকেল কারখানা ও হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শুরু করতে গিয়েই সমস্যায় পড়েন তারা। ডেসটিনি পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তাদের সব উদ্যোগ থামিয়ে দেয়। এজন্য গ্রাহকদের রিবেট দিতে পারছেন না। তারা কেউই প্রতারক নন। সরকার সুযোগ দিলে তারা আবারও ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত দিয়ে, আইনের ভেতর থেকে আবারও তারা ব্যবসা পরিচালনা করতে চান।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/শিমুল খান/খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here