আশা বর্ষা

আশা বর্ষা :: নদীর ধার ঘেঁষে ছোট-বড় ঝোপঝাড় ঘেরা জঙ্গলের বুক চিরে এই পথ। এখান দিয়েই তিতির প্রতিদিন হেঁটে যায় স্টেশনের দিক। কত রংবেরঙের গাছ–কোনওটা গাঢ় সবুজ, কোনওটাবা হালকা, আবার হলুদের মাঝে লালছোপ নিয়ে কেউ যেন নতজানু হয়ে আছে মহীরুহের কাছে। বড়ো ভালো লাগে তিতিরের।

শহরের স্কুলে শিক্ষকতা করে তিতির। ফিরতে সেদিন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিছু কেনাকাটা ছিল। সেই প্রিয় পথ ধরে চলছে তিতির। গুনগুন করে গাইতে গাইতে, ”আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি”- হঠাৎ হালকা একটা বাতাস যেন ওকে ছুঁয়ে গেল।

না, এবারে জাপ্টে ধরলো, তীব্র বুনো গন্ধ। বুনো বাতাসের গন্ধে কী অদ্ভুত এক মাদকতা! থমকে গেল তিতিরের পথচলা। বুনো বাতাসটা যেন ওর পথ আগলে রয়েছে, কিছুতেই এগুতে দিচ্ছে না! তিতিরও কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবেশে বাতাসটাকে গায়ে মেখে নিচ্ছে। এদিকে সন্ধ্যে গড়িয়ে চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

হঠাৎ তিতিরকে বিস্মিত করে বুনো বাতাসে ভেসে ভেসে অন্ধকারে এক আশ্চর্য আলো নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো এক যুবা, যেন রাজপুত্তুর! এতটাই সুদর্শন- তিতির অপলক চেয়ে রইল তার দিকে।

বুনো বাতাস তার গতি বাড়িয়ে দিল, গাছগুলো আনন্দে মাথা দোলাতে লাগল। যুবা তার দৃঢ় হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি এই বনানীর রক্ষক, ধরতে পারো রাজা। সে অনেক গল্প, পরে তোমাকে শোনাবো। আমাকে ভয় পেয়ো না, যাও, আজ বাড়ি যাও।”

ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছে তিতির। ঘোর যেন কাটছেই না। বুনো বাতাসের শিরশিরে অনুভূতিটা এখনো লেগে আছে গায়ে। মা-য়ের ডাকে চমক ভাঙল, “কিরে, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।” ঘোরের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে বিছানায় এল। ঘুম কিছুতেই আসছে না।

বারবার বুনো গন্ধ ছড়িয়ে বুনো বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে আবার তড়িঘড়ি কাজ সেরে স্কুলের পথে রওনা। জঙ্গলের রাস্তায় পা বাড়াতেই ভিতরে কেমন একটা অনুভূতি হলো। কয়েক পা এগুতেই অনুভব করল কখন যেন বুনো বাতাস তাকে ঘিরে ধরেছে। কাউকে দেখতে পেল না। শুধু ভরাট কণ্ঠে কেউ বলল, “ভয় নেই এগিয়ে যাও।” এভাবেই চলছিল দিনগুলি।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ কালো করে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক। এরই মধ্যে তিতির স্কুলের জন্য রেডি, জঙ্গলের পথে যখন পৌঁছলো তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে হাঁটছে … হটাৎ এক বীভৎস আওয়াজ কানে এলো, চোখ গেল জঙ্গলের গভীরে।

বিশাল চেহারা নিয়ে কোন দানব যেন ওরই দিকে এগিয়ে আসছে; ভারী কিছু আছড়ে পড়ল ওর গায়ে। জ্ঞান হারাল তিতির। যখন জ্ঞান ফিরল, বুঝতে পারল এক মাতাল করা বুনো গন্ধ নিয়ে সযত্নে ওকে জড়িয়ে আছে বুনো বাতাস। ও কিছু বলতে যাচ্ছিল, বুনো বাতাস থেকে ভেসে এল- “বিপদ কেটে গেছে, একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘরে যাও। বলেছিতো আমি যতদিন জঙ্গলে আছি, সব বিপদ থেকে আমিই তোমাকে রক্ষা করবো। আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু।”

বছর খানেক হলো প্রত্যয়ের সঙ্গে সুন্দর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তিতিরের। মা-য়ের ইচ্ছে, আসছে মাসেই চার হাত এক করে দেবে। দিন ঠিক হলো মাঘের দশ তারিখ। হাতে মাত্র এক মাস। দেখতে দেখতেই মাঘের দশ এসে হাজির। ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। সকলের চোখের আড়ালে একান্তে তিতির প্রত্যয়ের কাছে এসে বসলো। প্রত্যয়ের হাত এখন তিতিরের হাতের ওপর। একটা হালকা বাতাসে তিতিরের শরীর তিরতির করে কেঁপে উঠল।

মুহূর্তে মাতাল করা বুনো গন্ধ নিয়ে বুনো বাতাস তাকে জড়িয়ে ধরেছে। চোখ বুজলো তিতির, আর কিছু সে জানে না। এভাবেই পাঁচ বছর কেটে যায়। আজও প্রত্যয়ের সাথে ঘনিষ্ট মুহূর্তে বুনো বাতাস তিতিরকে জড়িয়ে ধরে। তিতির আর জ্ঞান হারায় না। অদ্ভুত এক সুখানুভূতিতে তিতিরের শরীর-মন ভরে ওঠে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here