স্টাফ রিপোর্টার :: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১৮ নং কুশাখালি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ফরাশগঞ্জে অবস্থিত সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের স্কুল ‘ডা. মোমতাজ উদ্দিন আলোকিত স্কুল এন্ড কলেজের’ শতাধিক শিক্ষার্থীর মাঝে বিনামূল্যে স্কুল ব্যাগ বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় বাচ্চাদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পাশপাশি একবেলা আনন্দভোজের আয়োজনও করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ২২ ফেব্রুয়ারি এই আয়োজনটি ঘিরে বিদ্যালয়টি সেজেছে নিজস্ব ঢংয়ে। শিক্ষার্থীরা মেতেছে আনন্দের উৎসবে।

বাচ্চাদের এই আয়োজনে লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ শাহজান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও জরুরি কাজে তিনি লক্ষ্মীপুরের বাহিরে ছিলেন। আলোকিত স্কুলের আয়োজন নিয়ে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর নিজ কার্যালয়ে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ বিতরণের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এ সময় জেলা পরিষদের কার্যনির্বাহী সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন লিকা এবং আফজাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন ও আলোকিত পাঠাগারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যয় সংগ্রহ করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া সহায়তার পোস্ট থেকে, ঠিক এমনটি জানিয়েছেন আলোকিত পাঠাগার ও আলোকিত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আরিফ চৌধুরী শুভ।

বাচ্চাদের একটি করে স্কুল ব্যাগ প্রদান, একবেলা আনন্দভোজ ও বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সহায়তা চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার পর প্রায় ৮০ হাজার টাকার মতো সহযোগিতা পেয়েছেন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। সহযোগিতাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আরিফ শুভ। তাঁর বিশ্বাস ভবিষ্যতেও সমাজের সুবিধা বঞ্চিত এই শিশুদের পাশে যেকোন প্রয়োজনে সবাইকে সাথে পাবেন।

পুরো আয়োজনটি ছিল একেবারে ভিন্নরকম এবং প্রাণচঞ্চল। ভাষার মাসে এমন আয়োজন ঘিরে বিদ্যালয়টি সেজেছে বর্ণের সাজসজ্জায়। আলোকিত পাঠাগারের একঝাঁক তরুণ পাঠক প্রতিনিধি বিদ্যালয়টি সাজিয়ে দিয়েছে।বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পেরে তারাও সন্তুষ্টির ঢেকুর তুললেন।

বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে ঢাকা থেকে অতিথি হিসেবে এসেছেন বাংলদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট এমএন জামান, লক্ষ্মীপুর জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ড. সালাহ উদ্দিন শরীফ, লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হারুনর রশিদ বাবুল, ভবানীগঞ্জ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক কবির উদ্দিন, জনতা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক নাহিদ হাসান রাফি, চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর সদস্য মো. নাজিম উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মুক্তযোদ্ধা সংসদের সদর থানা কমান্ডার মাহবুবুল আলমসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। অতিথিরা আলোকিত পাঠাগার ও আলোকিত স্কুলের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ সেজেছে মু্ক্তিযুদ্ধে হারানো সন্তানের মা, কেউ স্কুল শিক্ষক আবার কেউ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানা কমান্ডার মাহবুবুল আলমকে কাছে পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারারো মা শিক্ষার্থী সবার সামনে গিয়ে বললো, ‘আমি মুক্তিযদ্ধে আমার আদরের নয়ন মনি আমার একমাত্র সন্তান বিজয়কে হারিয়ে ফেলেছি। সবার চোখে বিজয় কিন্তু আমার বুক এখনো খালি। এতটি বছর আমি নি:স্ব ছিলাম বিজয়কে হারিয়ে, আজ আমি আমার আরেক সূর্য সন্তানকে কাছে পেয়েছি। আমার আনন্দ অশ্রু টলমল করছে এই মুহুর্তে। তার আবেগ আপ্লুত কথা শুনে তাকে কোলে তুলে নিলেন কমান্ডার মাহবুব আলম। এ সময় উপস্থিতির মাঝে একটি নিরব আবেগঘণ দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। শিশু শিক্ষার্থীটির নাম সাইমা আলম। সে আলোকিত স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

তৃতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী হিমু সেজেছিল স্কুল শিক্ষিকা। সে বলে, আমি এই স্কুলের শিক্ষিকা। এইখানে আমার সন্তানেরা কত কষ্ট করে লেখাপড়া করে। আমি বিনাবেতনে আমার সুবিধা বঞ্চিত সন্তানদের ২০১৩ সাল থেকে শিক্ষা দিয়ে আসছি। আমার সন্তানরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদের একজন। কিন্তু আমি আর পারছি না, আমি কার কাছে সহযোগিতার কথা বললে আমার দু:খ গুছবে। কিন্তু আমি আমার বাচ্চাগুলোর জন্য সহযোগিতা চাই। কে নিবে ওদের দায়িত্ব।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্টের মার্স্টাসের শিক্ষার্থী আরিফ চৌধুরী শুভ বলেন, আজ আমরা এই শিক্ষার্থীদের সুবিধা বঞ্চিত বলছি নানা কারণে, অথচ আমিও হতে পারতাম এদের মত একজন। আমার গ্রামে আমিই প্রথম দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থী হয়ে যেমন আনন্দবোধ করি, তেমনি সবার আগে এই শিক্ষার্থীদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনাটা আমার প্রথম দায়িত্ব মনে করি। আমি চেষ্ট করে যাচ্ছি। মেঠোপথে এই শিশুরাই আগামীতে আলো ছড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।

আয়োজনের শেষে স্থানীয় নলডগী ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিমের হাতে বাঙ্গালী জাতির পিতাও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল ছবি তুলে দেয়া হয়। ৮০ দশকের শেষে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসায় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি নেই এটি আরিফ শুভর দৃষ্টিতে আনেন ঐ মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা ও আরিফ শুভর বড় বোন ফেরদৌসী আক্তার। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বিষয়টি মানতে পারেননি আরিফ শুভ ওতার বোন। তারপরই ঢাকা থেকে ঐ মাদ্রাসার জন্য বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল ছবি নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষককের হাতে তুলে দেন আরিফ শুভ।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here