আমি গার্মেন্টস কর্মীআমার নাম আব্দুল কুদ্দুস (কল্পিত), বয়স-২১, আমি একজন গার্মেন্টস কর্মী, চট্টগ্রাম শহরের প্রানকেন্দ্র বন্দর থানাধীন সিইপিজেডের একটি গার্মেন্টস এ কাজ করি আমি। পরিবারের সকলের সুখের কথা চিন্তা করেই এ পথ বেছে নেয়া। আজ আমি আমার গল্প বলব।
১৯৯৬ সাল কোন এক খর পরতার দিনে জন্ম হয় আমার। নিম্নমধ্যবিত্ত এক পরিবারের বড় ছেলে হলে যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তার সবটুকুই তিলে তিলে পাচ্ছিলাম আমি। দুই ভাই এক বোনের পরিবারে মা-বাবা সহ পাচ সদস্যের পরিবার আমাদের। বাবার অল্প কিছু কৃষি জমির আবাদ আমার পরিবারের চাহিদার সবটুকু দিতে না পারায় রোজগারের দিকে ঝুকতে হয় কৌশরেই।
এক এক করে আরও যখন সমস্যা আসতে শুরু করে তখন কুল কিনারা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাকে ছুটতে হয় শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের শিল্প কারখানাগুলোতে।কোন এক হৃদয়বানের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত ঠাই মিলে আজকের এই সুবিশাল কারখানায় যেখান থেকে আমাকে সুন্দর একটা উপাধিও দেয়া হয়েছে -গার্মেন্টস কর্মী।
একজন গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে সকাল ৬:৩০ থেকে শুরু করে রাত বারটা পর্যন্তই কাজ করে পার করতে হয় আমাকে, মাঝে মাঝে তা আবার বেড়ে যায় পরদিন সকাল ছয়টা পর্যন্তও। নিম্নবেতনের একজন গার্মেন্টস কর্মী হওয়াতে ভিতরের এবং বাহিরের সব কাজ আমাকে একাই করতে হয় কারণ ছয় হাজার টাকার জব করে চাইলেই দুই হাজার টাকায় বুয়া রেখে বাকি টাকা দিয়ে পরিবারকে পাঠানো, নিজের খরচ মেটানো সত্যিই দুরুহ হয়ে যায়। তাই সব কাজ নিজে করেই শান্তি পাওয়া এক যুবকের নামই গার্মেন্টস কর্মী।
সূর্য উঠি উঠি করেও উঠে না পুরো অন্যদিকে একটু একটু কুয়াশার আদলে গা হিম শীতল হয়ে যায় তখন পেটের দায়ে হলেও কম্বলটালে আলতো সরিয়ে বালিশটাকে দুরে ঠেলে গা সরিয়ে নিতে হয় ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ।। যখন অফিসের কর্মঘন্টা শুরু হবে তখন না চাইতেও আমাকে সকাল ছয়টা তিরিশেই ঘুম থেকে উঠে রান্না -বান্না, গোসল, খাওয়া দাওয়া সেরে হাজির হতে হয় লাখ লাখ শ্রমিককে ঠেলে।
জরাজীর্ণ এক আবাসস্থলে পঞ্চাশোর্ধ লোকের জন্য বরাদ্দ থাকে একটি টয়লেট, ভোর হতে না হতেই বদনা বা লোটা নিয়ে বিশাল লাইনে সামিল হতে হয় নিত্য প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হলে। তা সারার পরেই তো সব শেষ না। এক ফ্লোরে থাকা চারটি মাত্র চুলোয় যখন সবার রান্না সারতে হবে তখন বিশাল লাইন ঠেলে প্রথমে যাওয়ার মিছিলটাও কম কষ্টের নয় তা বুঝতে আর কার ই বাকি থাকে!
যাক সে কথা বলে কয়ে যখন বুঝানো যাবে না তখন চোখ রাখি বাহিরের চিত্রে, ঘর থেকে বেরুতে না বেরুতেই লাখ মানুষের পায়ের ছাপ, একটু এদিক থেকে অদিক ফিরলেই আপনি গঙ্গার জলের ন্যায় ভেসে যেতে পারেন সীমানার একদম বাহিরে, জনস্রোত না ভাসতে হলে অবশ্যই চাই সামনের সাড়িতে তীক্ষ্ম দৃষ্টি।
এক নবীন লেখক একবার তার এক প্রবন্ধে এভাবে বলেছিলেন,”আমার কাছে এ দেশের সবচেয়ে সময়ানুবর্তী মানুষ বা চাকুরীজীবী বলে মনে হয় গার্মেন্টস কর্মীদের”। তার এ মন্তব্যের কারণ মাত্র বিশ মিনিটে গার্মেন্টস কর্মীদের এত ভিড় ঠেলে কর্মে পৌছায় সংগ্রামের চাক্ষুষ প্রমানিত চিত্র।
যা বলতে গিয়ে পিছলে গেলাম, এত কিছুর ভিড় ঠেলেও যে প্রত্যহ সঠিকক সময়েই নিজ কর্মস্থলে পৌছে কাজে মনযোগ দিতে পারে সেই গার্মেন্টস কর্মী। আমার গর্ব হয় এটা ভেবে যে আমি অন্যদের চেয়ে বেশী পরিরিশ্রম করতে জানি এবং একজন গার্মেন্টস কর্মী যার ঘামের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়।
আমার দিনটাকে যদি তিনটা ভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায় তবে অন্যদের মত এখানে মধ্যভাগ বা দুপুর বলতে কোন শব্দ খুজে পাওয়া যাবে না কারণ আমি বা আমরা এর নামকরণ করেছি অফিস টাইম হিসেবে। জানি না কবে শেষ আমাকে রবি আলিঙ্গন করতে পেরেছে বা আবার কবে করবে।
হতে পারে রবির সাথে কোন বিরোধের জের ধরেই আমাকে আটকে রাখার এ ফন্দি। সকাল আটটায় যখন আমার কর্মঘন্টা শুরু হয়ে শেষ হতে হতে রাত আটটা তখন এর মাঝে বেশ কয়েকবার গায়ের ঘামে চুপচুপে হয়ে গোসল সেরে নেয় গায়ের জামাটি। আপনি এখন যে জামাটি বা পেন্টটি পরে এখন এ পোস্টটি পড়ছেন তাতেও হয়ত থাকতে পারে একফোটা চক্ষু নিশ্রিত অশ্রু বা গন্ধযুক্ত কাল পানি। কথা তুলতে পারেন কেন আপনার গায়ের দামী জামাটাকে আমার অল্প পয়সার চোখের পানিতে ময়লাযুক্ত করেছি।
বলতে পারি তবে তাতেই যে সব ব্যথা মুছে যাবে তা কি করে বলি বা বুঝি। চোখের জলের পেছনের গল্পটা আজ আর নাই বা বলি, অন্য একদিন বলব চুপিসারে, যেদিন গার্মেন্টস কর্মীরাও দেখবে সূর্য, বলবে গল্প চাদনী রাতের, বলবে হেসে আমিও ছিলাম আজ দুপুরের সাক্ষী।
হুড় হুড় করে হুড়মুড়িয়ে ছেলে মেয়েগুলো একসাথে একের পর এক দীর্ঘ লাইন করে হেটে যাচ্ছে নিজের ঘরে। কবিতায় পরেছিলাম, পাখিরা সকাল সকাল খাবারের খোজে বের হয়ে সন্ধ্যা হলে নীড়ে ফিরে স্বস্তির নিশ্বাস নেয় একটু বিশ্রাম নিবে বলে। কিন্তু আমি পারি না,আমি গার্মেন্টস কর্মীঃ সব কাজ আমাকে করতে হয় না, পারতে হয় না যা অন্য কয়েকটা স্বাভাবিক ছেলেমেয়ে করতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যেই।
আমি গার্মেন্টস কর্মী বলে আমার থাকতে নেই কোন স্বাদ আহলাদ, থাকতে নেই কোন বাড়তি চাহিদা, থাকতে নেই দিনভর কর্ম শেষে বিছানার সাথে নিবিড় ভালবাসা। চরের গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই, যেখানে দখলদাররা পানি শুকাতেই হুড়মুড়িরে পরে জায়গা দখলে আবার নিজ স্বার্থ হাসিল হলে অন্যকে হস্তান্তরও করে হরহামেশাই। প্রতিটি গার্মেন্টস কর্মী এক একজন দখলদারের ন্যায় বাসায় ফিরেই দখলে নিতে হয় তাদের ঘরের পাশের খালি চুল্লিটার, দখলেই শেষ নয় -করতে হয় আবাদ, শস্য আহরণ আরও কত কি।
তবুও এ যাত্রীর ঘুমোবার সময় হয়না শুরু। ফররুখ আহমেদের পান্জেরীর অপেক্ষা করতে করতে একসময় দেখা যায় ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্টের মত সব আপেল না কুড়োতেই ঘুমের কোলে নুইয়ে পরতে হয় আমাকে।দিন শেষে মধ্যরাত, মধ্যরাত পেরিয়ে শেষ রাত হলেও চোখের ঘুম চোখে আসতে চায় না। পিঠের নিচে পরে থাকা শব্দের সবচেয়ে দ্রুতগতির মাধ্যমটা আমার সব ঘুম যেন কেড়ে নিল।
শরীরে ব্যথা, চোখে জল, মনের ভিতর পাথর জিইয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করা ছেলেটাই একদিন বড় হবে বলে আশা করে, দিনরাত কষ্ট করে, মায়ের মুখ দেখে হাসবে বলে কান্না করে। সে গার্মেন্টস কর্মী, আমি গার্মেন্টস কর্মী…!!
২৬/০৩/২০১৮
লেখক: সায়েম মাহামুদ, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। sayemkajal@gmail.com
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here