স্টাফ রিপোর্টার :: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথা ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের অমর সুরে ফুটে ওঠা গভীর অনুভব ও বেদনার দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। আত্মত্যাগের অহংকারে জ্বলে ওঠার অনন্য এক দিন আজ। ভাষার অধিকারের পথ বেয়ে ভাষাভিত্তিক আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনায় জেগে ওঠার দিন আজ।
রক্ত-পলাশ ফোটার ৮ ফাল্কগ্দুনের, একুশে ফেব্রুয়ারি আগুনঝরা দিনে মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে রাজপথ রাঙানোর স্মৃতি ও উত্তরাধিকার বাঙালি বহন করে চলেছে টানা ৬৮ বছর ধরে। বহন করবে আজীবন। অনেক বছর পর এবার আবারও ৮ ফাল্কগ্দুনেই উদ্যাপন হতে চলেছে চির প্রেরণার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি।
রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ এই মহান শহীদ দিবস শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, সফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামের সূচনা ঘটে এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণ ও জাতিগোষ্ঠীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে এ দিবস পালন এক অনন্য উদ্যোগ।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, সারাবিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
আজ সরকারি ছুটির দিন। ভাষাশহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হচ্ছে শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে।
বিশ্বের সকল জাতিসত্তার ভাষা রক্ষার দিন হিসেবে জাতিসংঘ বেছে নিয়েছে বাঙালি জাতির ভাষার জন্য লড়াইয়ের এ দিনটিকে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজ বাংলাদেশের পাশাপাশি ইউনেস্কোর ১৯৫টি সদস্য এবং ৯টি সহযোগী সদস্য রাষ্ট্রের ছয় হাজার ৯০৯টি ভাষাভাষী মানুষ পালন করবে এই দিবস। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য সাধারণ অর্জন।
‘একুশ মানে মাথা নত না করা’- চিরকালীন এ স্লোগান স্বমহিমায় ভাস্বর। এখনও যে কোনো ক্রান্তিকালে একুশ আমাদের প্রেরণা জোগায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ভাষা আন্দোলন জাতির বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের পরিচয় তুলে ধরে। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়েই জড়িয়ে রয়েছে একুশের প্রেরণা। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দল-মত নির্বিশেষে উদযাপন করার মতো এমন কালজয়ী দিন এ দেশে দ্বিতীয়টি নেই। তাই অমর একুশে উদযাপনে বাঙালির আবেগ হয়ে ওঠে বাঁধনহারা।
নানা আয়োজন, কর্মসূচি :ভাষাশহীদদের স্মরণে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় রাত ১২টা ১ মিনিটে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন একুশের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এরপর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
অমর একুশে উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচল ও সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতরাত ১২টা ৪১ মিনিটের পর এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অমর একুশে উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হবে।
প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ভাষাসংগ্রামী, কূটনীতিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দিবসটি উপলক্ষে আজিমপুর কবরস্থান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তায় অতিরিক্ত জনসমাগম ও ভিড় নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও র্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি শহিদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থান ও সংলগ্ন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার, ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসার হেড অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বিয়েট্রিস কালডুন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী বক্তৃতা করবেন।
আওয়ামী লীগও দিবসটি পালন উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আগামীকাল শনিবার বিকেল ৩টায় মাতৃভাষা দিবসের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠান হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। এতে সভাপতি ত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনা করবেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় নেতারা।
বিএনপির কর্মসূচি :মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিএনপি সকাল ৬টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করবে। সকাল ৬টায় কালো ব্যাজ সহকারে বলাকা সিনেমা হলের সামনে দলীয় নেতাকর্মীদের জমায়েত এবং সেখান থেকে প্রভাতফেরি আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের মাজার জিয়ারত শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমূখে যাত্রা এবং শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে।
মহান একুশে উপলক্ষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গতকাল এক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, অধিকার আদায় এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে ভাষাশহীদরা প্রেরণার উৎস। মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আত্মত্যাগের যে গৌরবদীপ্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।