মুজাহিদুল ইসলাম সোহেল, নোয়াখালী প্রতিনিধি:: ‘বেঁচে থাকবো,আপনাদের সাথে কথা বলবো,স্বামী সন্তানের মুখ দেখবো তা কখনো মনে করিনি। আমাকে আল্লাহ বেঁচে রেখেছেন এটাই কল্পনা। আসামিরা আমাকে টেনে-হিঁছড়ে ঘরের বাহিরে নিয়ে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। দুইজন আমার দুই হাত ধরে রাখে। আরেকজন পরনের কাপড় ছিঁড়ে মুখ বেঁধে ফেলে। এরপর একের পর এক আসামিরা আমাকে ধর্ষণ করে’। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতের নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার নারী (৪০)।

রোববার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়। নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মোহাম্মদ সামস্‌উদদীন খালেদের আদালতে মামলার অভিযোগপত্রভূক্ত ৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড ও আসামিপক্ষের আইনজীবিদের জেরা অনুষ্ঠিত হয়। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আদালতে নির্যাতনের শিকার নারী কান্নায় ভেঙে পড়ার পর বিচারক সাক্ষীকে স্বাভাবিক হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের অনুরোধ করেন।

এসময় আদালতে সাক্ষী নির্যাতনের শিকার নারী তাঁর নাম-পরিচয় তুলে ধরে বলেন, সেই দিন রাতের (৩০ ডিসেম্বর) খাবার খেয়ে তিনিসহ পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত সাড়ে বারোটার দিকে ঘরের বাহির থেকে আসামি ছালাউদ্দিনের ডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তখন তিনি কে জিজ্ঞেস করলে ছালাউদ্দিন বলেন ‘আমি ছালাউদ্দিন’।

আদালতকে নারী বলেন, পরিচয় জানার পর তিনি শোয়া থেকে উঠে বাতি জ্বালান। এরপর তিনি ও তাঁর স্বামী মিলে দরজা খুলে দেন। এসময় ছালাউদ্দিন, সোহেল, আবু, হেঞ্জু মাঝি, বেচু, স্বপন, চৌধুরী ঘরে ঢুকে। আর রুহুল আমিন মেম্বারসহ (বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা) অন্য আসামিরা বাহিরে ছিল।

নির্যাতনের শিকার নারী নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আসামিরা ঘরে ঢুকেই প্রথমে আমার মেয়ের কক্ষে গিয়ে তাকে নষ্ট (ধর্ষণ) করার চেষ্টা করে। এসময় আমরা তাদের হাত-পা ধরে তাকে ছেড়ে দিয়ে আমার চার সন্তান ও স্বামীকে বেঁধে ফেলে। এরপর আমাকে টেনে-হিঁছড়ে ঘরের বাহিরে নিয়ে যায়।’

নির্যাতিত নারী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আদালতকে আরও বলেন, ‘বাহিরে নেওয়ার পর আসামি সোহেল (পিতা-ইসমাইল) ও বেচু তাঁর দুই হাত ধরে রাখে। আর বাকি আসামিরা আমাকে কিল, ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আসামিরা আমার পরনের কাপড়-ছোপড় খুলে ফেলে। ব্লাউজ ছিঁড়ে আমার মুখ বেঁধে ফেলে।’

নির্যাতনের বর্ণনায় নারী বলেন, ‘মুখ বাঁধার পর আসামিরা টেনে তাঁকে ঘরের পশ্চিম পাশে পুকুরের পূর্ব পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে একের পর এক আসামি আমাকে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে আসামি বেচু বলে জবাই করে পুকুরে ফেলে দে। স্বপন বলে জবাই করিছ না মার। তখন সোহেল, বেচু গাছের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আমার ডান হাত ভেঙে দেন। তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’

নির্যাতিত নারী আদালতকে বলেন, সকালে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একাধিক সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করা হয়। কিন্তু আসামি রুহুল আমিন, বেচু সিএনজি আমাদের বাড়িতে আসতে দেয়নি। পরে মাইজদী থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাঁকে জেলা সদরের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

সাক্ষ্য দেওয়ার পর আসামি পক্ষের আইনজীবির জেরার জবাবে নির্যাতনের শিকার নারী বলেন, পরদিন (৩১ ডিসেম্বর) সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে স্বামী, ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। সেখানে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ অনেক পুলিশ তাঁর সঙ্গে কথা বলে। আসামিদের সঙ্গে তাঁর পূর্বের কোনো বিরোধ ছিল না।

জেরার এক পর্যায়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী হারুনুর রশীদ হাওলাদার নির্যাতনের শিকার নারীকে ‘দুর বেডি’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেন। এসময় আদালত আইনজীবিকে ভাষার ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করেন। তাৎক্ষনিক আইনজীবি ‘সরি’ বলে ক্ষমা চান।

এসময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি ছিলেন, মামুনুর রশিদ লাভলু, মোল্লা হাবিবুর রসুল মামুন এবং আসামী পক্ষের আইনজীবি ছিলেন, হারুনুর রশিদ হালদার, আবুল হোসেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here