জার্মান নাম ফ্রিডরিশ ডেয়ার গ্রোসে, ইংরাজিতে তিনি ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট নামেই পরিচিত৷ ৩০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একাধিক কারণে প্রাশিয়ার এই রাজাকে স্মরণ করা হচ্ছে৷
বিদ্রোহী যুবরাজ
১৭১২ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর জন্ম৷ সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছিল৷ হোয়েনসলার্ন রাজবংশের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী, শিশুটিকে ঘিরে এমন আশা দানা বাঁধছিল৷ প্রথমদিকে অবশ্য যুবরাজের মধ্যে তেমন লক্ষণ দেখা যায় নি৷ বাবার কাছে ঘোড়া চড়া বা কুচকাওয়াজ শেখার বদলে মা ও দিদির কাছে বসে বই পড়তে ভালবাসতেন ফ্রেডেরিক৷ বাবা ছেলেকে কড়া হাতে শাসন করতে গেলে ছেলে বিদ্রোহ করে উঠলো৷ ১৮ বছর বয়সে প্রাসাদ ছেড়ে পালানোরও চেষ্টা করেছিলেন যুবরাজ৷ তার মনোবল ভেঙে দিতে প্রথমে তাকে জোর করে এক রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো৷ কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টেকে নি৷ ততদিনে ফ্রিডরিশ সংগীত ও দর্শন নিয়ে মেতে উঠেছেন৷ সংস্কৃতি জগতের সৃজনশীল ব্যক্তিদের সান্নিধ্যের ব্যবস্থাও করেছেন৷ তবে সেই গোলটেবিল আড্ডাও বেশিদিন টিকলো না৷ ফ্রিডরিশের দীর্ঘ বক্তৃতা শুনতে শুনতে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়তেন৷ ফ্রান্সের প্রখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ার ছিলেন তাঁর বন্ধু৷ জার্মান নয়, ফরাসি ভাষায় কথা বলতেই পছন্দ করতেন ফ্রিডরিশ৷
সংস্কারমুখী শাসক
যুবরাজের সুখের দিনও শেষ হয়ে গেল৷ বাবার মৃত্যুর পর বাধ্য হয়ে রাজ্যপাটের হাল ধরতে হলো ২৮ বছর বয়স্ক যুবরাজকে৷ প্রাশিয়ার রাজা বলে কথা, শুধু সংস্কৃতি চর্চা করলে তো আর চলবে না! আজকের বার্লিন, ব্রান্ডেনবুর্গ, পোল্যান্ডের এলাকাই ছিল মোটামুটি ১৭৪০ সালের প্রাশিয়া৷ বহু জাতি ও ভাষার এই এলাকাকে আজকের সংজ্ঞায় ঠিক রাষ্ট্র বলা কঠিন৷ যাই হোক, সিংহাসনে বসে ফ্রেডেরিক ব্যাপক সংস্কারের কাজে হাত দিলেন৷ এমনকি আইন করে শারীরিক অত্যাচার বা দলনের প্রথাও বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি৷ প্রজাদের মাঝে শস্য বিতরণ বা সবে পরিচিত আলুর চাষে উৎসাহ দেওয়ার মতো কৃতিত্বও তাঁর ঝুলিতে৷ রাজ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ মনে করিয়ে দেয়, যে তিনি যুগের তুলনায় কতটা এগিয়ে ছিলেন৷ প্রোটেস্ট্যান্ট প্রাশিয়ায় তিনি মুসলিমদের মসজিদ ও ক্যাথলিকদের ক্যাথিড্রাল তৈরি করিয়েছিলেন৷ সেই যুগে ইউরোপের কোনো শাসক এমন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবেন নি৷
নিষ্ঠুর যুদ্ধবাজ রাজা
কিন্তু যুদ্ধে গেলে সেই দয়ালু ফ্রেডেরিক’কে আর চেনা যেত না৷ উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তিনি কঠোর হাতে প্রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করেছেন৷ জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হতো, প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়াও ছিল ভয়ংকর কঠিন৷ পালিয়ে গেলে নিষ্ঠুর শাস্তি নিশ্চিত ছিল৷ সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ আনুগত্য দাবি করতেন ফ্রেডেরিক৷ কিন্তু সেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত৷ তবে যুদ্ধের সময় নেপথ্যে থেকে নয়, ফ্রেডেরিক নিজের নিরাপত্তার পরোয়া না করে একেবারে সামনের সারিতে থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ যুদ্ধের রীতি-নীতি, কৌশল ভালই রপ্ত করেছিলেন৷ হারজিতের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিতেন৷ তিলে তিলে তিনি প্রাশিয়াকে ইউরোপের পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছেন৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুদ্ধের ধকল সামলাতে পারেন নি ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট৷ ৫১ বছর বয়সে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে বার্লিনে ফিরলেন তিনি৷ আরও ২১ বছর বেঁচে ছিলেন রাজা৷
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
ফ্রেডেরিক’কে কখনোই ভুলতে পারে নি জার্মানি৷ তাঁর প্রভাব আজও ছড়িয়ে আছে সর্বত্র৷ রক্ষণশীলরা চিরকাল প্রাশিয়ান গুণাগুণকে আদর্শ হিসেবে মেনে এসেছে৷ যুগে যুগে সেনাবাহিনী তাঁর দেখানো পথে চলে আসছে৷ রাজনীতিক ও সামরিক কর্তারা নিজেদের স্বার্থে ফ্রেডেরিক’কে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে এসেছে৷ তাঁর মূল্যায়নও হয়েছে নানাভাবে৷ কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি তাঁকে সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষক হিসেবে তুলে ধরেছে৷ কিন্তু রাজাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই৷ তিন শতক ধরে তিনি জার্মানির উপর প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন৷
সূত্র : ভয়চেভেলে
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/নিউজ ডেস্ক