নীলফামারীর ঘরে ঘরে চলছে নবান্নের ধুম। মঙ্গার মাস কার্তিকে ঘরে ধান আসায় মহাব্যস্ত দিন কাটছে কিষাণ-কিষাণীদের। পুরোনো প্রবাদ ‘হাতি ঠেলা যায়, কিন্তু কার্তিক ঠেলা যায়না’ বাক্যকে হার মানিয়েছে আগাম জাতের ধান।
মঙ্গার জেলা নীলফামারীতে এ মাসকে বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। মঙ্গার হাতছানিতে চারিদিকে চলতো হাহাকার। কাজ না থাকায় দিনমজুর ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের থাকতো না ক্রয় ক্ষমতা। ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দিন কাটাতো। ছড়িয়ে পড়তো ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ বালাই। আর এ কারণে মৃত্যু হতো অনেকের। কিন্তু এবার পাল্টে গেছে সে দৃশ্যপট। সেই মরা কার্তিকে আগাম জাতের ধান আবাদ করে মঙ্গাকে করেছে জয়।
প্রবাদ আছে “হাত্তিক ঢেলা যায় কিন্তু কার্তিক ঢেলা যায়না’। মরা এ কার্তিক মাসে হাতে কোন কাজ না থাকায় অলস সময় কাটত নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের। ফলে নিদারুন অভাবের মুখোমুখি হতে হতো এসব মানুষকে। কিন্তু এবারের দৃশ্যটা একটু ভিন্ন। জেলার বির্স্তিণ জমিতে এবার আবাদ হয়েছে বিভিন্ন জাতের হাইব্রীড ধান। এরই মধ্যে সোনালী রং ধরেছে এসব ধানে। আর তাই পাকা ধান ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, জেলায় এবার ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে বীনা-৭, ব্রী ধান-৩৩, হাইব্রীডসহ বিভিন্ন জাতের আগাম ধান চাষ করা হয়েছে যা মোট রোপা আমনের প্রায় ৩০%। বির্স্তিণ এসব জমিতে দোল খাচ্ছে এসব পাকা হাইব্রীড ধান। আর কিষাণ-কিষানীরা এখন মহা ব্যস্ত এসব ধান কাটা-মাড়াই ও ঘরে তোলার কাজে। স্বল্প মেয়াদী এ ধান ঘরে তুলেই এই জমিতেই তারা রোপণ করবে আলুসহ অন্যান্য রবি ফসল। জেলার ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নের নিলাহাটি গ্রামের কৃষক সুকুমার রায় (৫০) জানান, তিনি এবার এক একর জমিতে বীণা-৭ জাতের হাইব্রীড ধানের চাষ করেছেন। অনুকুল আবহাওয়া এবং যথাযথ পরিচর্চার ফলে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। ধান কাটা হয়েছে। এ জমিতেই এখন আলু লাগাবেন বলে জানালেন তিনি। একই গ্রামের রবীন্দ্রনাথ রায় (৪০) জানান, হাতে কোন কাজ না থাকায় অন্যান্য বছর এসময়টা খুব কষ্টে কাটত। কিন্তু আগাম জাতের এ ধান চাষ করে অভাব দুর হয়েছে। পাশাপাশি এর খড় দিয়ে গরুর খাবারও হচ্ছে।
কৃষকদের দিন কোন রকমে কেটে গেলেও মরা কার্তিকে ক্ষেতে কোন কাজ না থাকায় মানবেতর জীবন কাটাতে হতো কৃষি শ্রমিকদের। পরিবারের চাহিদা মেটাতে কাজের তাদের সন্ধানে ছুটতে হতো বিভিন্ন জায়গায়, করতে হতো ধারদেনা। আগাম জাতের এসব ধান হওয়ায় একদিকে কৃষকরা যেমন হয়েছেন লাভবান তেমনি শ্রমিকরা পেয়েছে কাজের সংস্থান। নিলাহাটি গ্রামের দীনা কান্ত (২৫) জানান, ৩/৪ বছর অগেও এলাকায় কোন কাজ না থাকায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজের সন্ধানে যেতে হতো। পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হতো। এখন এই ধান হওয়ায় ধান কেটে কিছু রোজগার করতে পারছে। একই কথা বললেন অক্ষয় চন্দ্র, গোপাল চন্দ্রসহ কয়েকজন কৃষি শ্রমিক।
মাটি তুলনামুলক উঁচু হওয়ায় অন্যান্য বছর পতিত থাকত এসব জমি। কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরনের ফলে কৃষকরা ঝুঁকেছে আগাম জাতের এসব ধান চাষে। ডোমার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, এ অঞ্চলের মাটি বেলে-দোঁআশ প্রকৃতির। ফলে আগে বেশিরভাগ জমি পতিত থাকত। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আগাম জাতের ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ জানান, কৃষকদের বাড়তি আয়, কৃষি শ্রমিকদের কাজের সংস্থান ছাড়াও রবি ফসলের প্রয়োজনীয় পূঁজির যোগান দিতে এ ধান বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ পুঁজি দিয়ে তারা পরবর্তী মৌসুমের ফসলের খরচ যোগাতে পারবে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/নুর আলম/নীলফামারী