এস এম শফিকুল ইসলাম, জয়পুরহাট
প্রয়োজনীয় আখ সরবরাহের অভাবে গত মৌসুমের চেয়ে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন চিনি কম উৎপাদন করে আগেই বন্ধ হয়ে গেল দেশের বৃহত্তম চিনিকল ‘জয়পুরহাট সুগার মিলস্ লিমিটেড’ এর চলতি ২০১১-২০১২ ইং মৌসুমের ৪৯তম আখ মাড়াই। কাঙ্খিত পরিমান আখ না পাওয়ায় চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যহত হবার কারনে স্বাভাবিক ভাবে এবারও এ চিনিকলকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হবে। এবার লোকসানের অংক গত মৌসুমের চাইতে ৪/৫কোটি টাকা বেশি হবার আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১২কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে গত ২০১১সালের ২৫নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে জয়পুরহাট সুগার মিলস্ লিমিটেডে ৮০হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৬হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে ২০১১-২০১২ইং মৌসুমের আখ মাড়াই শুরু হয়েছিল। আখ থেকে চিনি আহরণের হার(রিকোভারী) ধার্য করা হয়েছিল ৭দশমিক ৫০ শতাংশ।
প্রায় ২মাস (৬০দিন) আখ মাড়াই চলবে এমন ধারনা করা হলেও মাড়াইয়ের জন্য নির্ধারিত পরিমান আখ না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মাড়াই চলেছে মাত্র ৪৯দিন। এমনি অবস’ায এ চিনিকলে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা মারাত্মক ভাবে ব্যহত হয়েছে। প্রয়োজনীয় আখের অভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই বৃহস্পতিবার রাতে শেষ হয়েছে মিলের চলতি মৌসুমের আখ মাড়াই কার্যক্রম। যদিও মিলের ফ্যাক্টরতে চিনি প্রক্রিয়াকরণ (উৎপাদন র্কাক্রম) আরও ৭২ ঘন্টা ব্যাপি চলবে।
তবে মাড়াইয়ের জন্য আখের ডোঙ্গায় আর নতুন করে আখ ফেলা হবে না।এক সপ্তাহ পূর্বে চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকার সকল আখচাষীদের চিঠি দিয়ে ১২জানুয়ারির মধ্যে তাদের ক্ষেতে থাকা সব আখ চিনিকলে সরবরাহের জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত শেষ বারের মত এ মৌসুমের আখ মাড়াই কার্যক্রম চলে শুক্রবার শেষ হয়েছে।
গত ২৫নভেম্বর আখ মাড়াই উদ্বোধন থেকে ১২জানুয়ারি পর্যন্ত এ চিনিকলে ৪৯টি কর্মদিবসে মোট ৬৩হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪হাজার ২শ’ মেট্রিক টন (আগামী ৭২ঘন্টা পর প্রকৃত উৎপাদনের পরিমান জানা যাবে)। যা গত মৌসুমের চাইতে ২হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন কম। এবার আখ থেকে চিনি আহরণের অর্জিত হার ছিল ৬দশমিক ৮শতাংশ। ফলে গত মৌসুমের মত এবারও এ চিনিকলকে বইতে হচ্ছে লোকসানের বোঝা। গতবারের চাইতে এবারের লোকসানের অংকটা বেড়ে গিয়ে ১৬ থেকে ১৭কোটি টাকা দাঁড়ানোর আশঙ্কা সংশ্নিষ্টদের।
এমন লোকসানের কারণ হিসেব আখচাষী নেতারা দায়ী করছেন মিল কর্তৃপক্ষকে। অন্যদিকে, মিল কর্তৃপক্ষ বলছে, আখের সরবরাহ কম থাকায় এমন কম চিনি উৎপাদন আর লোকসান দিয়ে বন্ধ করতে হচ্ছে মিলের আখ মাড়াই।
গত মাড়াই মৌসুমে এ চিনিকলে ৯৯হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৬হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল। চিনিকলে আখ মাড়াই হয়েছিল ৬৭ দিন। তারপরও লোকসান হয়েছিল প্রায় ১২কোটি টাকা।
জয়পুরহাট চিনিকলের ইক্ষু সংগ্রহ ব্যবস’াপক আব্দুল বারী আজকালের খবরকে জানান, নানা কারণে মিল জোন এলাকায় দিন দিন কমে যাচ্ছে আখচাষ। তাছাড়া আখের মূল্য কম হওয়ায় জোন এলাকার চাষীরা মিলে আখ সরবরাহ না করে গুড় তৈরিতে ব্যবহার করছেন। কাজেই সরবরাহ কম থাকায় এমন কম চিনি উৎপাদন আর লোকসান দিয়ে বন্ধ করতে হচ্ছে মিলের আখ মাড়াই।
তবে বর্তমানে দাম বৃদ্ধি করায় আগামী মৌসুমে আখচাষ ও চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছে মিল কতৃপক্ষ।
আখচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বাবু চৌধুরী জানান, ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে আখচাষে আগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যয় কমানো এবং মাথাভারী প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জেলার একমাত্র এ ভারী শিল্পটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, সুষ্ঠু ব্যবস’পনার মাধ্যমে কৃষকদের ন্যায্য দাবি আর দেশের বৃহত্তম এই চিনিকলের স্বার্থ রক্ষার মধ্যে সমন্বয় করা হলে এ শিল্প ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য।
প্রয়োজনীয় আখ সরবরাহের অভাবে হঠাৎ করে চিনিকরের মাড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এ চিনিকলের বড় অংকের লোকসান হবার কথা অকপটে স্বীকার করে এর কারণ সম্পর্কে জয়পুরহাট সুগার মিল্স লিমিটেডের ব্যবস’াপনা পরিচালক মোঃ শহিদ উল্লাহ বলেন,’চলতি মৌসুমে আবহাওয়া জনিত কারনে এমনিতেই আখের ফলন ভাল হয়নি,অন্যদিকে চিনির চাইতে গুড়ের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় জয়পুরহাট সুগার মিল নিয়ন্ত্রনাধীন নওগাঁর মহাদেবপুর ও মান্দা উপজেলা এবং দিনাজপুরের ফুলবাড়ি,চরকাই সহ বিভিন্ন এলাকার চাষীরা তাদের আখ চিনিকলে সরবরাহ না করে বেশি লাভ হওয়ায় গুড় উৎপাদনকারিদের নিকট সরবরাহ করেছে।
সে কারনে প্রত্যাশা মাফিক আখ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে জয়পুরহাট সুগার মিলকে। আর তাই কাঙ্খিত পরিমান আখ মাড়াই করতে না পারায় এবার চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়েছে। এ ছাড়াও অন্য কারনের মধ্যে রয়েছে চিটাগুড়ের (মোলাসিস) মূল্য হ্রাস। সব জিনিসের দাম বাড়লেও এ চিনিকলে বাই-প্রডাক্ট হিসেবে উৎপাদিত চিটাগুড় প্রতি টনে প্রায় ৪হাজার টাকা দাম কমেছে। গত বছর এর মূল্য ছিল ১২/১৩ হাজার টাকা। অথচ এবার এর দাম কমে ৮হাজারে নেমে এসেছে। ফলে চিটাগুড় বিক্রি করে কাঙ্খিত লাভ মিলেনি। এ সব কারনে এবার এ চিনিকলকে বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। ’তবে ধান,আলু সহ অন্যান্য ফসলের দাম যে ভাবে কমেছে সে তুলনায় আখের মূল্য এখন বেশি। এটা কৃষকরা অনুধাবন করতে পেরেছেন।
সে কারনে আগামীতে আখের চাষ নিশ্চিত বাড়বে। আর প্রত্যাশা মাফিক আখের চাষ হলে এবং সে আখের সরবরাহ চিনিকলে নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই এ চিনিকল প্রয়োজনীয় আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর তাতে র্দীঘ দিনের এ লোকসানে কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এ চিনিকল বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন ।