কাজী মোসাদ্দেক হোসেন,গাজীপুর থেকে
আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফা । মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা দিল্লীর মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। লাখো লাখো মুসলিম অংশ নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানদের কল্যাণ কামনা করে প্রার্থনা করেছেন। রোববার দুপুর ১২.৩৫ মিনিট থেকে ১২.৫৪ মিনিট পর্যন্ত আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গত শুক্রবার থেকে শুরু হয় ইজতেমার প্রথম পর্ব। তাবলিগ জামায়াতের সদস্যদের পাশাপাশি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এতে যোগ দিতে থাকেন, বয়ান শুনতে উপস্থিত হন ইজতেমা ময়দানে। রোববার সকাল থেকে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জেলার মুসল্লিদের ঢল নামে টঙ্গীপানে। ইজতেমা এলাকায় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করায় অনেকেই হেঁটে আসেন ময়দানে। সকালে ইজতেমা ময়াদানে গিয়ে দেখা যায় তা কানায় কানায় পূর্ণ। মুসল্লীরা মাঠের আশে-পাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ময়দানে ঢুকতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামাড়পাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। আশপাশের বাসা-অফিস-দোকানের ছাদেও ছিল মানুষের ভীর। তুরাগ নদীতে নৌকায় লঞ্চেও অনেক মুসল্লিরা অবস্থান নেন।
ইজতেমা মাঠের বিদেশি নিবাসের পূর্ব পাশে মঞ্চ থেকে আখেরি মোনাজাত শুরু হওয়ার আগে হেদায়তি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সাদ। সকাল নয়টা থেকে মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলে হেদায়তি বয়ান। বয়ানে মাওলানা সাদ বলেন, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেয়। তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য সওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামায়াত সওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে সওয়াল না করা।
বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে এ মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারতের প্রখ্যাত আলেম ও বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ স্থানীয় মুরুব্বি মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। তিনি বিশ্বের সকল মুসলমানদের কল্যাণ কামনা করে প্রার্থনা করেছেন, লাখো লাখো মুসুল্লির অংশ গ্রহনে প্রার্থনা করে বলেন, দুনিয়ার জিন্দেগী ক্ষণস্থায়ী, আল্লাহর কাছে আমল ছাড়া এ দুনিয়ার জিন্দেগীর কোনো মূল্য নেই। আরো বলেন, দীনের দাওয়াতের মাধ্যমে ঈমান মজবুত হয়। ঈমান মজবুত হলে আল্লাহর সঙ্গে গভীর স¤পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ স¤পর্ক গড়ে ওঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়। দাওয়াতি কাজে জানমাল খরচ করলে আল্লাহ তা আরো বাড়িয়ে দেন।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ইজতেমার দোয়া মঞ্চে পৌঁছেন ১২টা ২০ মিনিটে, আর বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া অ্যাটলাস হোন্ডা কারখানা ভবনে বিশেষ মঞ্চে মোনাজাতে অংশ নিতে উপস্থিত হন ১২টা ১৫ মিনিটে।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণ কামনার প্রার্থনায় শরিক হন। ইজতেমার মূল বয়ান মঞ্চে ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।
বরাবরের মতো টঙ্গীর বাটা সু কারখানার ছাদে প্রধান মন্ত্রীর বিশেষ প্যান্ডেল করা হলেও তিনি মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নিয়ে মোনাজাতে শরীক হন গণভবনে। বিরোধীদলীয় নেতা মোনাজাত করেন হোন্ডা (এটলাস) কারখানার ছাদে বসে। তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, এম এ মান্নান, ফজলুল হক মিলন, হাসান উদ্দিন সরকার, সালাউদ্দিন সরকার, শাহান শাহ প্রমুখ।
চার দিন বিরতি দিয়ে আবার ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ইজতেমা। মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর যাবৎ টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুক্রবার লাখো মুসল্লি একসঙ্গে জুমার নামাজে অংশ নেন।
রোববার সকাল থেকে বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে টঙ্গী অভিমুখী মানুষের ঢল নামে। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসল্লি নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন সিট ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে তাতেই অবস্থান নিয়েছেন। এবারও তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বীরা রেডিও-টিভিতে মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি দেননি। তারপরও এনটিসহ কিছু কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইজতেমা গত বছরের মতো এবারও আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
মোবাইল ফোনে মোনাজাত
ইজতেমা স্থলে যেতে পরিবহন সংকট ও ভিড় এড়াতে গাজীপুরের কয়েকটি স্থানে এলাকাবাসি মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইজতেমার মূল মাঠ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে কয়েক হাজার মুসল্লি জমায়েত হন। পরে তারা মোবাইল ও পুলিশের ওয়াকিটকির মাধ্যমে ইজতেমা স্থলে যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন। একইভাবে জেলার ভোগড়া, বাসন সড়ক ও
শিমুলতলী এলাকায় মোবাইল মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় মোনাজাত শেষে যানজট ও মানবজট
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মুসল্লিরা শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় যান ও মানুষের জট। ফলে আবারও পায়ে হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর পায়ে হাঁটা মুসল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন রোববার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থেমে থাকবে।
গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ
ইজতেমার কারণে আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রগতি সরণী এবং টঙ্গী সেতু থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিমানযাত্রী, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। এই অবস্থা থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তবে আখেরি মোনাজাতের দিন রোববার সকাল থেকে কোনো বাসকে মহাখালীর পর উত্তরার দিকে যেতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা মহানগরের যে সব মুসলি হেঁটে শাহজালাল বিমানবন্দর গোলচত্বর আজমপুর-আব্দুলাহপুর হয়ে টঙ্গীসেতু দিয়ে না গিয়ে তুরাগ নদীর ওপর নির্মিত ভাসমান সেতু অথবা কামারপাড়া সেতু ব্যবহার করতে হবে।
টঙ্গীবাসীদের ঘরে ঘরে ইজতেমার মেহমান
টঙ্গীর ঘরে ঘরে এখন ইজতেমার মেহমান। বিভিন্ন সময় দাওয়াত দিয়েও যাদের আনা সম্ভব হয় না, তাদের অনেকেই আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে এসে টঙ্গীতে আত্নীয়দের বাসায় উঠেছেন।
এবারে নারী মুসুল্লীদের ভিড়
বিশ্ব ইজতেমায় মহিলাদের অংশগ্রহণ ও অবস্থানের কোনো সুযোগ নেই। ইজতেমাস্থলে আসার ব্যাপারে আয়োজক কর্তৃপক্ষের নিষেধ রয়েছে। তারপরও ইজতেমার বয়ান শুনতে ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ইজতেমা মাঠের বাইরে স্থানে স্থানে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে মহিলাদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে। হজে যেতে না পারলেও হজের পর মুসলমানদের এ বৃহত্তম জমাতে আসতে ও ধর্মের মূল্যবান বয়ান শুনতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছেন তারা।
১৯৪৬ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতে ইজতেমা
হতো ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। এরপর ১৯৪৮ ইং-এ চট্টগ্রামের হাজি ক্যা¤েপ এবং ৫৮তে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ইজতেমায় লোক সমাগম বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন। এরপর থেকে এখানেই ইজতেমা চলে আসছে।
মোসাদ্দেক হোসেন