আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁদুরের আনাগোনাআসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট প্রতিনিধি :: ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারীতে শীতে সামান্য জ্বর, মাথা ব্যাথা ও শ্বাসকষ্টে, সুদীপ্ত, সাগর, অরন্য আর অনন্যা’র মতো ২৪ টি প্রান ঝড়ে গিয়েছিল একেবারেই অজান্তে। কিন্তু একে একে যখন লাশের মিছিল ভারি হচ্ছিল তখন গণমাধ্যমের খবরে ঢাকা থেকে আইইসিডিআর-এর বিশেষজ্ঞ দল হাতীবান্ধার উদ্যেশ্যে শম্ভূক যাত্রা শুরু করে। তখনও চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে অজানা রোগে ৮ টি তাঁজা প্রানের মৃত্যু হয়েছিল মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে।

দীর্ঘ যাত্রা শেষে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটে বিশেষজ্ঞ টিমের গাড়িটি যখন পৌঁছলো তখন ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত সাড়ে ১০ টা। ঠিক সেই মুহুর্তে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা আরও একজনের প্রানহানী ঘটলো তখনকার অজানা ওই রোগটিতে। এক দিন পর এ রোগে আক্রান্ত হয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সাজু’র স্ত্রী শারমিন জামান মেরী। ফলে সংবাদ কর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে এক আতংক।

পাঁচ সদস্যের ওই বিশেষজ্ঞ টিমটি পরদিন থেকে কাজ শুরু করে রোগটি অনুসন্ধানে। এর ফাঁকে না ফেরার দেশে যাওয়ার তালিকার সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। প্রতিদিনের মৃত্যুর খবরে এলাকবাসীও ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ায় প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় পুরো এলাকা। প্রায় ৫ দিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রোগ তথ্য গবেষনকারী বিশেষজ্ঞ টিম সংবাদ সম্মেলন করে যখন ওই অজানা রোগটিকে বিজ্ঞানী নিউটনের ইউরেকা সুত্রের মতো ঘাতক “নিপা ভাইরাস” হিসেবে আবিস্কার করলো তখন সরকারি হিসেবে মৃত্যর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ১৯ এ।

আইইসিডিআর-এর ভাষ্য মতে ভাইরাসটির কোন প্রতিশোধক নেই, তাই জনসচেতনতা তৈরীর মাধ্যমেই তা থেকে রক্ষা পাওয়াই একমাত্র পথ। কেননা শীতের সময় এই নিপা নামক ভাইরাসটি একমাত্র বাদুরই বহন করে থাকে। বহনকারী বাদুর যখন শীতকালের খেঁজুরের রসের হাড়িতে বসে আর ফল খায় তখন লালার মাধ্যমে নিপা ভাইরাস ছড়ায়। তাই রস খেতে হবে ফুঁটিয়ে আর ফল খেতে হয় ধুয়ে। স্বাস্থ্য শিক্ষা বুরে‌্যার এই সামান্য মন্ত্রটুকু নিতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা বাসীকে সর্বমোট ২৪ টি প্রান দিতে হয়েছিল।

সেই সাথে কর্তৃপক্ষ হাতীবান্ধা এলাকাকে ঝুকিপূর্ন বলেও ঘোষণা দেন। কারণ যে এলাকায় একবার নিপা ভাইরাস দেখা দেয়, সেই এলাকায় আবারও শীতের সময় এর আক্রমন থাকে বলে তাদের কাছে থাকা প্রমান তুলে ধরেন সাংবাদিকদের কাছে। কেননা মালোয়শিয়ার নিপা নামক গ্রাম থেকে সৃষ্ট ঘাতক “নিপা ভাইরাস” প্রথম আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশের ফরিদপুরে। সেখানে পরের বছর আবারও প্রানহানী ঘটে। তবে হাতীবান্ধায় নিপা ভাইরাসের আক্রমণ ফরিদপুরের সেই রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যায়।

আবার এসেছে সেই শীত। আইইসিডিআর-এর ঘোষণা অনুযায়ী নিপা ভাইরাসের ঝুঁকিপূর্ন এলাকা হাতীবান্ধায় এখন পর্যন্ত জনসচেতনার কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ রমজান আলী বলেন, যেহেতু শীত এসে গেছে তাই কয়েক দিনের মধ্যে কাঁচা খেঁজুরের রস ও বাঁদুর বা পাখি খাওয়া ফলমুল খাওয়ার ব্যাপারে একটি স্বাস্থ্য বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লালমনিরহাট সিভিল সার্জনের নির্দেশে প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। হাতিবান্ধা উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নের তথ্য সেবা কেন্দ্রের উদ্যোগে জনসচেতনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এ দিকে দেশের উত্তর জনপদের শেষ প্রান্তের এই উপজলায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দিনে দিনে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। ২০১১ সালের ফ্রেরুয়ারীতে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ের শোক এখনো কেঁটে উঠতে পারেনি হাতীবান্ধার বাসীন্দারা। তারপরে আবার এই শীতের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁদুরের আনাগোনা দেখে ভয়ে থরথর এলাকাবাসী। তাদের আতংক, না জানি কখন কোথায় ফাঁত পেতে প্রান কেঁড়ে নেয় নিপা বহনকারী বাঁদুর !

সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামঘুরে দেখা যায়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রানী বাঁদুর গাছের ডালে দল বেঁধে বসে আছে। ভালই লাগছিল তাদের অবাধ বিচরণ কিন্তু হঠাৎ করে কে যেন বলল, বাঁদুর দেখছেন! দেখবেন ওদের দলে কেউ আবার নিপা ভাইরাস ছঁড়াবে। মুহুর্তে বুকের কাঁপনি ওঠে পাশ ফিরিতেই চোঁখে পড়ে দক্ষিন ধুবনি গ্রামের বৃদ্ধা আলহাজ্ব আলী। তিনি বলেন, বাপ দাদার আমল থেকে বাঁদুর দেখছি বাবা।

কিন্তু সেই বাঁদুর দ্বারা নিপা নামক ঘাতক এসে আমাদের সন্তানদের কেঁড়ে নিবে তা কল্পনাও করিনি। তার কথায় এবার যোগ দিলেন দক্ষিন সিন্দুর্না গ্রামের সোলেমান আকন্দ। তারও দাবি বাঁদুর থেকে সবধান! হাতীবান্ধার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওই দুর্ঘটনার জন্য শুধু শুধু বাঁদুরকে দায়ী করছেন কেন? এমন প্রশ্নে তারা যেন একটু হোঁচট খেয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক এর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ যদি সময় মতো জনসচেতনতার উদ্যোগ নেয়, তাহলে হয়তোবা আর কোন অঘটন ঘটবে না। আলহাজ্ব আলীর এমন উত্তরে সোলেমান আকন্দের মুখ থেকে মুহুর্তে মেঘ উধাও হলো। মাথা দোলাতে দোলাতে তিনিও বলেলন, সত্যি তো।

হাতীবান্ধা বাসষ্ট্যান্ড এলাকার স্কুল শিক্ষক অশোক ঘোষের একছেলে-একমেয়ে। চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র অরন্য বরাবরের মতো ১ রোলের জায়গাটি ধরে রাখতো। ছোটবোন অনন্যা শিশু নিকেতনে প্লে-গ্র“পে পড়তো। খেজঁরের রস ও বড়ই খাওয়াতে অরন্যের মতো অনন্যাও দারুন উৎসাহী ছিল। হঠাৎ করে সামন্য জ্বরে অসুস্থ্য হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাত্র একদিনের ব্যবধানে নিপা ভাইরাসের আক্রমনে মৃত্যু হয়েছিল ওই দুটি ফুঁটফুঁটে শিশুর। গোটা পরিবার তাই আজও শোকের সাগরে ভাসচ্ছে। উপজেলার কলনী পাড়ার সুদীপ্ত সরকার। হাতীবান্ধা এস এস উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। মা মুক্তি রাণী সরকার তখন হাতীবান্ধা উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। বাবা সুবোল সরকার খেজুঁরের রস কিনেছিল পিঠা খাবেন বলে।

বাবা মায়ের অগোচরে দুরন্ত সুদীপ্ত সেই রস ফুটানোর আগেই যে খেয়েছিল, তা জানা গিয়েছিল হাসপাতালের বেডে যখন সে (সুদীপ্ত) প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে কাঁতরাচ্ছিল। আর সেই খেঁজুরের রসেই যে মৃত্যু নামক নিপাহ ভাইরাস মিশে ছিল তা আগে জানা ছিল না বাবা-মায়ের। ক’দিন আগে মা মুক্তি রানী এক অনুষ্ঠানে সুদিপ্তর স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। মঞ্চের সামনের দর্শকসহ বাকি অতিথিরাও চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি মুক্তি রানীর হৃদয়বিদারক সেই কথায়।

হাতীবান্ধায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৭ দিনে একের পর এক মৃত্যু যাত্রায় সুদীপ্ত’র মতো সামিল হয়েছিল মোট ২৪টি প্রাণ । এ রোগে আক্রান্ত ভাগ্য ক্রমে বেঁেচ ২ জন সাংবাদিক সাজু’র স্ত্রী শারমিন জামান মেরী ও গেন্দুকুড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী কুলসুম খাতুন এখনও শ্বাসকষ্টে ভুগছে। শারমিন জামান মেরী জানান, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি সব সময় মাথা ব্যাথা ও মাঝে মাঝে জ্বর আসে। আমার মাথার চুল উঠে যাচ্ছে।

আইইসিডিআর-এর বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, শীতের এই সময়ে নিপাহ ভাইরাসের একমাত্র বাহক বাদুর। ঘাতক ভাইরাসটি বাঁদুরের লালার মাধ্যমে খেজুরের রস ও বড়ই, কিংবা অন্যান্য শীতকালীন ফলের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যের সেই সময় সর্বশেষ সত্যতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় ৮ম শ্রেণীর ছাত্র মৃনালের মৃত্যুতে। পূর্ব বেজগ্রামের চিত্তরঞ্জনের পুত্র মৃনাল ওই সময়ের এক দুপরে বাড়ির উঠানে পড়ে থাকা বড়ই খেয়েছিল । বিকালেই তার শরীরে জ্বর আসে। রাতে তীব্র জ্বরসহ দেখা দেয় মাথাব্যাথা, খিচুঁনি ও শ্বাসকষ্ট। বাবা চিত্তরঞ্জন ডাক্তার নিয়ে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে মৃনাল।

এতগুলো প্রাণ হারিয়ে আজও নিরব কান্নায় সিক্ত হাতীবান্ধার মানুষজন। শোকাহত পরিবারগুলোতে এখনো চলছে বোবা কান্না। শুধু হাতীবান্ধায় নয় দেশের কোন মানুষ যেন অজান্তেই এমনি নির্মম ভাগ্যের শিকার না হয় সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য শিক্ষা বুরে‌্যার আগেভাগে জনসচেতনতা মুলক উদ্যোগ নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here