বড়দিনের বড় খুশি/ পুষি মনের ঘরে/ কে যেন ঐ নতুন করে পুরোনোকে পড়ে/ কে যেন ঐ নতুন করে হাসছে আগের হাসি/ কে যেন ঐ বাজায় শোন আনন্দমন বাঁশি/ সকল কিছুই তাঁর জন্য নিবেদিত যিনি/ মানবসেবায় আজন্মকাল করে গেছেন ঋণী…

বাংলাদেশ থেকে শত সহস্র কিলোমিটার দূরে ইতালির রোম শহর। একদিন রোমে এক দরিদ্র শীতার্ত শিশু হাজির হলো গরিব এক কাঠুরের ঘরে। দরিদ্র এই দম্পতি ছিলেন যীশু ভক্ত। তারা শিশুটিকে ঘরে নিয়ে নিজেদের খাবার খাওয়ালেন। শিশুটিকে নরম বিছানায় শুতে দিয়ে নিজেরা শুলেন শক্ত কাঠের ওপরে। সকালে সেই শিশু দেবদুতের রূপ ধরে বলল, তিনিই স্বয়ং যিশু। কাঠুরে দম্পতির আচরণে খুশি হয়ে একটি গাছের টুকরা দিয়ে শিশুরূপী যিশু বললেন তা মাটিতে পুঁতে দিতে। দম্পতিটি তাই করলেন। এরপরের ক্রিসমাসে দেখা গেলো ওই ডালটি সোনালী আপেলে ভর্তি হয়ে গেছে। এমন নন্দিত কাহিনীর সাথে সাথে আরো কিছু কাহিনী রয়েছে, তার একটি হলো- এক ক্রিসমাসে এক গির্জার মালির কাছে এলো এক শিশু। সে কিছু পাইন গাছের চারা নিয়ে এসেছে। মালি চারাগুলো কিনে নিলে সেই টাকা দিয়ে সে ক্রিসমাসে কিছু কিনতে পারবে। সব দেখে মালির খুব দয়া হলো। যদিও পাইনের চারাগুলো মোটেও ভালো না, মালির একটুও পছন্দ হয়নি, তবু সে চারাগুলো কিনে নিল। তারপর গির্জার পাশে চারাগুলি পুঁতে ঘুমিয়ে গেল। আর সকালে উঠে দেখে, কী অবাক কাণ্ড, এক রাতেই পাইনের চারাগুলো বড়ো হয়ে ছাড়িয়ে গেছে গির্জার ঐ চূড়োকেও! আর গাছগুলোর চূড়ো আর ডালপালা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে অজস্র তারার আলো। আর সেই থেকে ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন। ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন যে অনেক আগেই হয়েছে, তা জানায় আমাদের ইতিহাস। সবার আগে ক্রিসমাস ট্রি প্রচলন হয় রোমে। ওখানে অবশ্য খ্রিষ্টান ধর্ম প্রবর্তনের আগে থেকেই উৎসবে গাছপালা দিয়ে ঘর সাজাবার রীতি প্রচলিত ছিলো। পরে ওরা বড়দিনেও গাছ দিয়ে ঘর সাজাতে শুরু করে। এজন্য তারা বেশি ব্যবহার করতো হোম, আইভি আর বে গাছ। এই গাছগুলোর মধ্যে আইভি গাছ ব্যবহার করার আবার একটা বিশেষ কারণ ছিল। এর পাতাগুলো অনেকটা ‘হার্ট’ বা হৃদয়াকৃতির। রোমের খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাতাগুলো যিশু খ্রিষ্টের স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আগমনের প্রতীক। আবার এর কাঁটাগুলো ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মাথার কাঁটার মুকুটের প্রতীক। আর লাল লাল বেরিফলগুলো ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ফলে যিশুর শরীর থেকে যে রক্ত ঝরেছিল, তার প্রতীক। শুধু এখানেই শেষ নয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিট্রিশরা নরওয়েকে সাহায্য করেছিল। সেই উপকারের কথা মনে রেখে যুদ্ধের পর নরওয়ে ব্রিটিশদের একটি ক্রিসমাস ট্রি উপহার দেয়। সেই ক্রিসমাস ট্রি এখনো লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে আছে।

ইংরেজি ভাষায় Christmas tree শব্দটির প্রচলন হয় সম্ভবত ১৮৩৫ সালে। শব্দটি ইংরেজিতে এসেছিল জার্মান ভাষা থেকে। ধারণা করা হয়, আধুনিক ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন হয় জার্মানিতে, ওই ১৮ শতকেই। আবার অনেকে বলেন, ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা চালু করেন খ্রিষ্ট ধমের্র সংস্কারক মার্টিন লুথার, ১৬ শতকে। আর ১৮৪১ সালের দিকে ক্রিসমাস ট্রি পুরো বৃটেনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর বছর ত্রিশেকের মধ্যে আমেরিকাতেও ক্রিসমাস ট্রি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

খ্রিষ্টানরা ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে কিছু ধর্মীয় গান গায়। এগুলোকে বলে ক্রিসমাস ক্যারল। আর এই গানগুলো কিন্তু ক্রিসমাসের মতোই পুরোনো। সবচেয়ে পুরোনো যে ক্রিসমাস ক্যারলের কথা জানা যায়, সেগুলো রচিত হয়েছিলো ৪০০ বছররেও আগে! লাতিন ভাষার সেই ক্যারলগুলো লিখেছিলেন ইতালির মিলানের আর্চবিশপ অ্যামব্রোস। এরপর উলেস্নখযোগ্য ক্যারল রচিত হয় ৯ম ও ১০ম শতকে। তবে এগুলোকে ঠিক ক্যারল বলা যায় না, কারণ এগুলো মূলত ছিল কবিতা। এরপর ১২ শতকে অ্যাডাম অফ সেইন্ট ভিক্টরও কিছু উল্লেখযোগ্য ক্রিসমাস ক্যারল রচনা করেন। ১৩ শতকে এসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি আর ইতালিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ক্রিসমাস ক্যারল। তখনো কিন্তু ইংরেজিতে ক্রিসমাস ক্যারল রচনা করা শুরুই হয়নি। ইংরেজিতে প্রথম ক্রিসমাস ক্যারল রচনা করেন জন অডেল। ‘ক্যারল’স অফ ক্রিসমাস’ নামে পরিচিত তাঁর ২৫টি গান ‘ওয়েসেলার’রা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাইত। ক্রিসমাস ক্যারল মূলত এক ধরনের লোকসংগীত। আগে বিভিন্ন অঞ্চলের খ্রিষ্টানরা ক্রিসমাসে তাদের নিজস্ব ক্যারল গাইতো। এই চল বেশি ছিলো আফ্রিকান খ্রিষ্টানদের মধ্যে। আরো ভালো করে বলতে গেলে, আমেরিকায় যে সব খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী আফ্রিকানরা বসত করে, তাদের মধ্যে। আর এখন তো বড়দিনে ক্রিসমাস ক্যারল গাইতেই হবে। বিশেষ ‘জঙ্গিল বেল’ গানটা ছাড়া ক্রিসমাস উদযাপন নিয়ে থাকে অপূর্ণতা; তাই ক্রিসমাস সঙ হয়ে আছে বিভিন্ন নামের গান। গানে গানে তানে তানে এগিয়ে যেতে যেতে জানা যায়, অসংখ্য আশ্চর্য এবং নন্দিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান এই ক্রিসমাস; এই বড়দিন; এই শুভ দিন। আর এই শুভদিনের সূচনা নিয়েও আমাদের পৃথিবী কথা বলে। কথা বলে ইতিহাস। সেই ইতিহাসের আয়নায় আমাদের চোখ রাখলেই দেখতে পাবো, দুই হাজার ১৩ বছর আগের দিনগুলো। সেই সময়ে পবিত্র জেরম্নজালেম শহরের বেথলেহেম নামের এক জায়গায় আজকের এই দিনে এক ছোট্ট ঘরে জন্ম হয়েছিল এক শিশুর। তার নাম রাখা হয়েছিল যিশু। আর শিশুটির জন্ম হয়েছিল ঈশ্বরের ইচ্ছায়, মা মেরীর গর্ভে। এই যিশুই খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিষ্ট। ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে ক্রিসমাস বা বড়দিন পালিত হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা, তা অবশ্য নিশ্চিত করে জানা যায় না। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে আসেন যিশু। আর এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মদিন ধরা হয়। অন্যমতে একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মোৎসব পালন করা হয়। রোমানরা সেদিন ওই উৎসব পালন করতো কেন জানো? কারণ, সেদিন থেকেই পৃথিবীর উত্তরের দেশগুলোতে দিন আস্তে আস্তে বড়ো হতে শুরু করে।

Christmas শব্দটি আদিযুগের ইংরেজিতে ছিল Christemasse, আর মধ্যযুগে এসে শব্দটি Cristes masse শেষ যে শব্দটি, Cristes masse,, তার উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৩৮ সালের একটি ইংরেজি রচনায়। Cristes শব্দটি আবার গ্রিক Christos এবং শব্দটি লাতিন missa (পবিত্র উৎসব) শব্দ থেকে এসেছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Χ (চি) হল Christ বা খ্রিষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। এই অক্ষরটি আবার লাতিন ভাষাতেও আছে, X-(G·)। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকে তাই এই অক্ষরটি খ্রিষ্ট শব্দের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর তাই, ক্রিসমাসকে সংক্ষেপে X-mas লেখা হয়…

ক্রিসমাস বা এক্স-মাস হোক একটা গাছেই স্বর্ণফল/ মানুষ সবার সেরা যে তাই মানুষ হলো স্বর্ণকল/ এই যে কলে বানানো যায় সোনার মত মন/ যে মন থাকে মানবসেবায় স্বচ্ছ সারাক্ষণ…

মোমিন মেহেদী

mominmahadi@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here