গোলাম মোস্তাফিজার রহমান মিলন, হিলি সংবাদদাতা
কোভিড-১৯ মহামারীর আগে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার রাজস্ব ও আর্থিক উদ্দীপনামূলক পদক্ষেপ নিলেও কিন্তু সেই গতি আর ফেরেনি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনও ২০২০ সালের তুলনায় অনেক কম। ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ বিগত দুই অর্থবছরে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, রপ্তানি টিকিয়ে রাখার অসুবিধা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত ঋণ নির্ভরতা অর্থনীতিকে আরও বেহাল করেছে।
জুলাই-আগস্টের কোটা বিরোধী আন্দোলনে আর্থিক পরিস্থিতিও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গিয়েছে। কিন্তু হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মন্তব্য করেছে পরবর্তী কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শোচনীয় হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতাকেই এরজন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক ২০২৪- ২৫ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশ অনুমান করলেও ৯ অক্টোবর ‘উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার কারণে সেটা কমিয়ে বলেছে ৪ শতাংশ। এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কও তাদের এপ্রিলের ৬.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর বলেছে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৫.১ শতাংশ।
বেহাল অর্থনীতির প্রভাব জনজীবনে প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। অর্থনীতির প্রাথমিক সূচক গুলিতেও ধরা পড়ছে সেই প্রভাব। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশেরও বেশি। এটি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতাও প্রকট। অক্টোবরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। চলছে ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ণ। গত বছরের এই সময়ের ১.০৪ শতাংশের তুলনায় এখন টাকার অবমূল্যায়ণ হয়েছে ১.৬৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমতে শুরু করে। এখন অস্থিরতার কারণে তাদের আস্থা আরও কমেছে। গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর বিদেশি বিনিয়োগের পরিমান ছিল ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সেটা কমে হয়েছে ৭৫২ মিলিয়ন ডলার।
বিভিন্ন সেক্টরেই সঙ্কটের থাবা প্রসারিত হয়েছে। সঙ্কট সবচেয়ে বেশি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। উচ্চ নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বিপর্যয় ডেকে এনেছে ব্যাংক সেক্টরের। ২০০৮ সাল থেকে ৯.৫ গুণ বেড়ে চলতি বছরে জুনে এনপিএল দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। পাশাপাশি গত বছরের তুলনায় চলতি জুলাই ও আগস্ট মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় প্রায় ৫৫ বিলিয়ন টাকা কমেছে। আইএমএফের শর্ত মেনে এনবিআরকে প্রতি বছর রাজস্ব ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হয়। তাই কম রাজস্ব সংগ্রহ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করেছে।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি ঘাটতি ৫ শতাংশেরও বেশি। এরজন্য দায়ী ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখুন নীতি। রপ্তানি এই সময়ের মধ্যে ১০.৮২ বিলিয়ন থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১১.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ৮০ শতাংশ, ৯.২৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) সেক্টর থেকে। তবে এই তথ্য নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুতর জটিলতা এবং শ্রমিক অসন্তোষে বহু আরএমজি এখন বন্ধ।
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজও গত কয়েক মাসে জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রপ্তানি হ্রাসের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের পরামর্শ, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তবে অক্টোবরে রেমিট্যান্স ২.৩৯ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে।
আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইত্যাদির মতো মূলধন নিবিড় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য প্রচুর বিদেশী ঋণ নেয়। তাই ২০১৯ সালের জুন মাসের বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩৮.৫ বিলিয়ন থেকে চার বছর পর, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঢাকার তাৎক্ষণিক ঋণের চাহিদা ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাসের কারণে এই ঋণের বোঝা সামলানো বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন। তাই দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তারা একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অর্থনীতির উপর শ্বেতপত্র তৈরি করতে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেই বড় আকারের অনিয়মগুলি নজরে এসেছে। বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো সহ চারটি প্রধান খাতে ধরা পড়েছে ব্যাপক অনিয়ম।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিদেশি সহায়তা চাওয়া হয়েছে। যেমন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারের জন্য বাজেট সহায়তা হিসেবে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এলটিসি গ্রাজুয়েশন সমর্থন করার জন্য এডিবি থেকে আরও ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য চেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়াও চলমান ৪.৭ বিলিয়ন এএফএফ ঋণ ছাড়াও আইএমএফকে ৩ বিলিয়ন সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছে। বিশ্বব্যাংক থেকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাসও পেয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে বিদ্যমান ঋণের ১.৫ বিলিয়ন ডলার পুনঃপ্রয়োগ হবে।
তবে, আশুলিয়া-গাজীপুর আরএমজি শিল্প কেন্দ্রগুলিতে শ্রম সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা সরকারকে চিন্তায় রেখেছে। চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে (আরসিইপি) যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। এলডিসি নিয়েও দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কৌশলগত কিছু ইতিবাচক অবস্থান নিচ্ছে সরকার। ব্যাঙ্কিং সেক্টরে অ-পারফর্মিং অ্যাসেট এবং প্রধান ঝুঁকিগুলি চিহ্নিত করার জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সাহায্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইওরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান প্রধান রপ্তানি বাজারের সাথে যোগাযোগ করেছেন। এই বাজার গুলিতে বাংলাদেশ মোট রপ্তানির ৪৪ এবং ১৭ শতাংশ রপ্তানি করে। ইউএনজিএ-র ফাঁকে, ড. ইউনূস দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও গভীর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং অন্যান্য চাহিদা মেটাতে প্রায় ১৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত মানবিক সহায়তা ঘোষণা করেছে। সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীতকরার জন্য ইইউ বাংলাদেশের সঙ্গে একটি অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি (পিসিএ) নিয়েও আলোচনা শুরু করেছে।
বাংলাদেশে কিছু সোলার প্যানেল কারখানা স্থানান্তর করার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। শুধু পরিবেশ সুরক্ষাই নয়, বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প। এছাড়াও প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও কৃষিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা সংকটের জন্য চীনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তবে চীন থেকে এখনও আশাব্যঞ্জক তেমন প্রতিক্রিয়া আসেনি। চীন থেকে মিলেছে বাংলাদেশী পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, সংস্কার ও উন্নয়নের সহায়তায় প্রতিশ্রুতির আশ্বাস। বন্যার ত্রাণে সামান্য অনুদান এবং বিভিন্ন সেমিনারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো ছাড়া চীন থেকে মেলেনি কিছু। এমনকী, চীনের এক্সিম ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলির (পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং এবং রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সহ) অর্থ প্রদানে বিলম্ব নিয়ে আলোচনা করার বা প্রতিশ্রুতি ফি মওকুফ করার অনুরোধেও কর্ণপাত করেনি।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিতে লাভ হয়েছে পাকিস্তানের। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ঢাকাকে সমর্থনের অনুরোধ, পাকিস্তান কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (পিএআরসি) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক পুনর্নবীকরণের প্রস্তাব, ডিসেম্বরে ঢাকায় নবম যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা ও সমঝোতা স্বাক্ষর, প্রভৃতির মাধ্যমে ইসলামাবাদ ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতির ফায়দা নিতে চাইছে। বাংলাদেশের সাথে বিনিয়োগের প্রসার ও সুরক্ষার জন্য একটি চুক্তিও করতে চায় তারা। পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ১০০ শতাংশ চেকিং এখন আর বাধ্যতামূলক নয়। ফলে নিষিদ্ধ পণ্য চোরাচালানেরও সুবিধা পাবে ইসলামাবাদ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় ১০০ দিন অতিক্রান্ত। তারা মুখে বলছে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও দৃশ্যমান নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা। সেটা পাশাপাশি আর্থিক শৃঙ্খলা, ঋণ ব্যবস্থাপনা, ক্রমান্বয়ে কৃষি সংস্কার এবং স্বচ্ছতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সরকার পরিচালনাতেই সীমাবদ্ধ। একটি বৈধ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত করে দ্রুত নির্বাচনের কোনও তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলকেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজকর্মে হতাশা ব্যক্ত করতে দেখা যাচ্ছে। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইলেও সরকারের বিরুদ্ধে টালবাহানার অভিযোগ উঠছে। ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন আরও বিঘ্নিত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here