মুহাম্মদ রহমত উল্যাহ, নোয়াখালী থেকে

নোয়াখালীতে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতিস-ম্ভ নিমার্ণ কাজ শেষ হবে কবে? অযত্ন অবহেলায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের স্মৃতি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান গুলো। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোঃ রুহুল আমিনের ৪০তম শাহাদাত বার্ষিকী সাদামাটা ভাবে পালিত হলো গত ১০ ডিসেম্বর।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন তাদের অন্যতম হচেছন চট্রগ্রাম বিভাগের একমাত্র বীরশ্রেষ্ঠ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ৯নং দেওটি ইউনিয়নের বাঘপাচঁড়া গ্রামের রুহুল আমিন। চূড়ান- বিজয়ের মাত্র ৬ দিন আগে খুলনার রূপসায় শাহাদাত বরণ করেন এ বীরযোদ্ধা।

বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ রুহুল আমিনের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রয়ারী নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাঁচরা (বর্তমানে রুহুল আমিন নগর) গ্রামে। তার পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী, মা জুলেখা খাতুন। তিনি বাল্য জীবনে বাগপাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯৪৯ সালে আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। নৌবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৫৩ সালে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিএনএস বখতিয়ার ত্যাগ করে ভারতের ত্রিপুরা সীমান- দিয়ে ২ নং সেক্টরে যোগদান করেন। এখানে স’ল যুদ্ধে একাধিকবার তিনি অংশগ্রহন করে সাফল্য অর্জন করেন। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টর থেকে নৌবাহিনীর সদস্যদের সেপ্টেম্বর মাসে একত্রিত করা হয়। ভারত সরকারের উপহার ২টি  টাগ-বোটে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে শুরু হয় নৌ-যুদ্ধের প্রস’তি। গার্ডেন রীচ নৌ ওয়ার্কশপে টাগ-বোট দুটিতে দুইটি করে বাফার গান আর চারটি করে ৫০০ পাউন্ড ওজনের মার্ক মাইন বহন করার উপযোগী করে গানবোট রুপানি-ত করা।

১২ অক্টোবর গার্ডেন রীচ জেটিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে গানবোট দুটিকে পানিতে ভাসানো হয়। পরে রুহুল আমিন যুদ্ধ জাহাজ ‘পলাশ’ এর আর্টিফিসার অফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৯ ডিসেম্বর রাতে কোন বাধা ছাড়াই গানর্বোট ‘ পলাশ’ হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোঃ রুহুল আমিন চট্রগ্রাম নৌ-ঘাঁটির অধীনে পিএএস আর এ-১ ইঞ্জিন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১০ ডিসেম্বর রণতরী পলাশে কর্মরত ছিলেন। ১০ ডিসেম্বর খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছলে শত্রুর জঙ্গি বিমান থেকে মুক্তিবাহীনীর রণতরীর ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করলে ভারতীয় অধিনায়কের রণতরী ত্যাগের নির্দেশ উপেক্ষা করে রুহুল আমিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। রণতরী ‘পলাশ’ ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানো সহজ ছিলো। কিন’ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন তা না করে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করেন। এ সময় পশ্চিম দিক থেকে একটি জঙ্গি বিমান এস পলাশের ইঞ্জিন রুমে গোলাবর্ষণ করলে শত্রুর গোলার আঘাতের পলাশের ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়। রণতরীতে আগুন ধরে গেলে রুহুল আমিন মারাত্মক ভাবে আহত হন। আহত অবস’ায় ইঞ্জিনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন এবং আহত অবস’ায় ডাঙায় উঠতে চাইলে পাকিস-ানী হানাদার দোসর বাঙালী শত্রু ঘৃন্য রাজাকারেরা তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে।

সেই সাহসী বীরের স্মৃতি রক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে ২০০৮ সালের ১১ মার্চ তাঁর জন্মস’ানে পরিবারের সদস্য গণ কর্তৃক দানকৃত ০.২০ একর ভূমিতে ৬২.৯০ ( বাষট্রি লক্ষ নব্বই হাজার) টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পলিত ‘‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোঃ রুহুল আমিন গ্রস’াগার ও স্মৃতি জাদুগর’’। লাইব্রেরীতে প্রায় ৪ হাজার বই  রয়েছে ও তার ব্যবহারের কিছু জিনিস পত্র রয়েছে। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও  সড়কের বেহাল দশা। প্রতিদিন ৮০/৯০ জন পর্যটক বীরশ্রেষ্ঠ সম্পর্কে জানতে এখানে আসেন। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন শুধু নোয়াখালী তথা চট্রগ্রাম বিভাগের নয় পুরো বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠ। কিন’ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন নগরে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়নি। এখানে বীরশ্রেষ্ঠের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাদুঘর, লাইব্রেরী, স্কুল, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সড়ক ও প্রতিষ্ঠান গুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত।

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন জানান, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি শুধুমাত্র ভবন ছাড়া। এটাও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুযায়ী অপ্রতুল। শ্রেণী কক্ষ স্বল্পতা, বিজ্ঞানাগার, ছাত্রীকমন রুম ও বিদ্যালয়ের একটি সুন্দর মাঠ নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সড়কের বিষয়ে স’ানীয় অধিবাসীরা জানান, গত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ সড়কের নামকরণ হয় বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ রুহুল আমিন সড়ক। সেই থেকে এ সড়কটি আর সংস্কার করা হয়নি। ফলে যাতায়াত ব্যবস’া খুবই নাজুক। রাস-ায় কয়েক শত ছোট বড় গর্তের কারনে দূর্ঘটনা ও ঘটছে। এ পথে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীরা ও পড়েন চরম ভোগানি-তে।  জেলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনীর চৌরাস-ায় ২০০৮ সালে পুরাতন স্মৃতিস-ম্ভটি ভেঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতি স-ম্ভ কাম-ফোয়ারা নির্মাণ কাজ ২ বছরে ও শেষ হয়নি। সারা বছর এ স্মৃতি স-ম্ভটি রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যানার পোষ্টারের দখলে থাকে। কেবলমাত্র ১০ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ  মোঃ রুহুল আমিনের শাহাদাত বার্ষিকী এলেই পরিষ্কার পরিছন্ন হয় ফোয়ারাটি। প্রশাসনের নাকের ডগায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরের প্রতি এমন অসম্মানে অপমানিতবোধ করছে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধারা।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে স’ানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, পযার্প্ত বরাদ্দ না থাকায় এসব স’াপনা সংস্কার করা যাচেছ না । তিনি আর ও বলেন, বিদ্যমান সমস্যা গুলো সমাধানে সরকারের সংশিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে মৌখিক ও লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আমি সংসদ সদস্য হিসেবে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করছি।

এ বিষয়ে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের কন্যা নুরজাহান বেগম বলেন,‘ বিগত তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে আমাদের পৈর্তৃক জায়গার ওপর দেওয়া জমিতে স্মৃতি জাদুগর, গ্রস’াগার নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির ও জরাজীর্ণ দশা। সবচেয়ে দুঃখ জনক হলো বাবার নামে চট্রগ্রাম বিভাগীয় স্টেড়িয়ামের নামকরণ করা হলেও তা অজ্ঞাত কারণে পরে সেটি এম.এ হান্নানের নামে নামকরণ করা হয়।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের পরিবারে। মানবেতর জীবন যাপন করছে তার পরিবারের কয়েক সদস্য। বীরশ্রেষ্ঠের ছোট ছেলে শওকত আলী। বাবা বীরশ্রেষ্ঠ হলেও নিজে জীবন যুদ্ধে হেরে যাচেছন প্রতিনিয়ত। অসুস’ুতা আর দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সত্রী ও একমাত্র কন্যা শিশু কে নিয়ে কোন রকমে বেচেঁ আছেন শওকত। কখনো নান্দিয়া পাড়া বাজারে চায়ের দোকানে পানি টেনে বা করাত কলে গাছ টেনে কিংবা দিন মজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করে। বীরশ্রেষ্ঠের চাচাতো ভাই ও ছোট বেলার খেলার সাথী আবুল হাসেম বীরশ্রেষ্ঠের ছেলের দুর্দশা কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। শওকত বলেন, বাবা বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন এই গর্বে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকি। কিন’ অর্থাভাবে মংলা বন্দরে গিয়ে বাবার সমাধিটি দেখার সৌভাগ্য হয়নি আজও। তিনি সরকারের কাছে  আকুল আবেদন জানান, যেন তার বাবার সমাধিটি নিজ জন্মস’ানে আনার ব্যবস’া করা হয়। তিনি আর ও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের মূল্যায়নের  মাধ্যমে প্রর্দশিত হবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান।

বেগমগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্তার আবুল হোসেন বাঙালী জানান, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের নামে স্মৃতিস-ম্ভ নির্মাণের কাজ ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ ও শেষ হয়নি। এ জন্য আমরা মানববন্ধন ও করেছি। বর্তমানে এ স্মৃতিস-ম্ভের সামনের জাযগাটুকু দখল করে নিয়েছে কয়েকটি কু-চক্রী মহল। অথচ প্রশাসন তা অপসারনের কোন উদ্যোগ নেয়নি। একজন বীরের প্রতি এ ধরনের অসম্মান কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগমগজ্ঞ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার নুরুল হক জানান,‘ আমরা এ বীরের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানোর চেষ্টা করছি।

দেশের জন্য বীরের এমন আত্মাহুতির পুরুষ্কার হলো বীরশ্রেষ্ঠ। আর সেই বীরের স্মৃতি বেঁেচ থাকলে আগামি প্রজন্ম অনু-প্রাণিত হবে। দেশ মাতৃকার জন্য যে সাহসী আত্মত্যাগ তা জাগরুক হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান-রে। স’ানীয় সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি শ্রীঘ্রই ব্যবস’া নেবে সংশিষ্ট দপ্তরগুলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here