
শায়লা আখতার :: নারীর উপর সহিংসতা আমাদের দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। এর মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগও চলমান আছে। এরপরও দেশব্যাপী শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের নারী যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
দেশের প্রতিটি নারী ও শিশু সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি। এ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অথ্যাৎ প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ৪জন নারী শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী। শুধু পরিসংখ্যান বিবেচনায় ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের এই হার বাড়ার পরিমাণ প্রায় প্রতি লাখে ১.৩৫ জন বা এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে প্রতি লাখে এ হার ৮.১৮ জন ও ৭.১২ জন। আর ২০১৯ সালে প্রথম ছয় মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ১৫৯টি যা আগের হারের প্রায় দ্বিগুণ (সূত্র-বাংলাদেশ পুলিশ হেড়কোয়ার্টার্স ওয়েবসাইট, ২০১৯)।
অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে মোট নারী ও শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৭৩২টি, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৩টি (আসক, ২০২০)। যদিও নারী ও শিশুর প্রতি সার্বিক সহিংসতা বা নির্যাতনের প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও অনেক বেশী। এছাড়া ডয়েচ ভেলের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ধর্ষণের হার প্রতি লাখে ১০ জন এবং সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের অবস’ান ৪০তম।
পুলিশ স্টাফ কলেজের (২০১৮) গবেষণা অনুযায়ী, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের ৭০.৯ শতাংশের মাসিক কোন আয় নেই এবং ১৯.৪ শতাংশ নারী ও শিশুর মাসিক আয় ১০ হাজার টাকারও নিচে। এদের গড় মাসিক আয় মাত্র ২ হাজার ৮৪১ টাকা। যার কারণে এসব নারী ও শিশুর মামলা, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমান অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না, ন্যায়বিচারও তাঁরা পান না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের বিপরীতে ধর্ষকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা ভালো। একই গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ধর্ষকদের সামাজিক অবস্থানের মধ্যে ১৪.৯ শতাংশ ধনিক শ্রেণির সন্তান, ৯.১ শতাংশ রাজনীতিবিদদের সন্তান/আত্মীয় এবং ৪.৬ শতাংশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। এখানে প্রান্তিক ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে ধর্ষকদের অর্থনেতিকভাবে স্বাবলম্বীতা ও সামাজিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু ন্যয়বিচার পায়না।
বাংলাদেশে ধর্ষণের হার বাড়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আইনের শাসনহীনতা ভয়াবহ অনিয়ম ও ক্ষমতার দাপটে সারাদেশে প্রতিনিয়ত শিশু ও নারী যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে মেট্রোপলিটন এলাকায় নারী ও শিশু ধর্ষণের ট্রাইব্যুনালে যে বিচারগুলো হয় সেখানে মাত্র ২.৬ শতাংশ মামলায় চূড়ান্ত বিচারের রায় হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে মামলা প্রক্রিয়ায় তদন্ত ,ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট ও আইনজীবির অনাগ্রহ বা পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে চূড়ান্ত রায়ে মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। আইনগতভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে চূড়ান্ত চার্জ দেয়ার কথা থাকলেও পুলিশের কাজের চাপ ও পক্ষপাতদুষ্টতার জন্য বা প্রভাবশালী মহলের চাপে মামলার চার্জসিট সঠিক সময়ে দেয়া হয় না। আবার মামলার চার্জসিটের (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) দুর্বলতার কারণেও ভুক্তভোগী নারী ও শিশু ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
শুধু ধর্ষণের বিচার নয়, বাংলাদেশে যে কোন অপরাধের মধ্যে কোনটিকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে, কাকে বিচার প্রক্রিয়ায় আনা হবে, কাকে বাদ দেয়া হবে বা কাকে ফাঁসি দেয়া হবে তার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশ ইসলামি ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো নারীদের পর্দার কথা বলে নারীর ক্ষমতায়ন বা চলাচলকে রোধ করতে চায়। তারা ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে জড়িয়ে নারীকেই দায়ী করে। অথচ ধষণের শিকার হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই (৫৫%)। আবার নারীদের ক্ষেত্রে যাঁরা ধষণের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ধর্ষকের পরিচিত। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীর চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করলে কোন সমাধান হবে না বরং নারীর ক্ষমতায়ন ও বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর অধস্তনতামূলক মর্যাদার প্রথা ভেঙ্গে সমমর্যাদার ও সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত সন্ত্রাসী ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। নারী-পুরুষের জন্য স্বাভাবিক মুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে সরকারি-বেসরকারি ভাবে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, ডর্প।