কথায় আছে ‘বললে মায় মাইর খায়/ না বললে বাবা হারাম খায়’। আমারও ঐ একই অবস্থা। একসময় স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম।
আর তাই যদি সত্য কথা বলি, যদি সমালোচনা করি, যদি ভুলগুলো ধরিয়ে দেই তাহলে নাখোশ হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনেকেই।
আবার অন্যদিকে যদি তা না করি; তাহলে আওয়ামী লীগের ভুলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারো ক্ষমতায় আসার প্রাণন্তকর চেষ্টা করবে বাংলাদেশ বিরোধী-স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির। আর একারনেই নতুন প্রজন্মের রাজনীতি সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে বলছি কয়েকটি কথা। লিখছি কিছু বিষয়। আশা করি রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতিতে তৈরি হচ্ছেন, তারা শুধরে যাবেন।
১০ নভেম্বর ‘৮৭ আমাদের ইতিহাসে একটি স্মরনীয় দিন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের একটি অন্যতম মাইল ফলক এ দিবসটি। এ দিন এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী নিজেদেরকে বীরের আসনে বসাতে গুলি করে শ্রমিক নেতা নূর হোসেনের উপর; শহীদ হন নুর হোসেন।
আমাদের অনেকেরই সেইসব দিন দেখার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য হয়নি, আবার অনেকেরই হয়ত বোঝার মত বয়সও হয়নি। প্রতি বছর ১০ই নভেম্বর তারিখটি এলেই ইতিহাসে ভিড় করে সেসব উত্তাল দিনের স্মৃতি।
সেই সময় এরশাদ সরকারের পতনের জন্য নিবেদিত হয়ে আজকের আওয়ামী লীগ যেভাবে জাতীয় পার্টির সাথে জোট করেছে, ঠিক একই ভাবে জোট করেছিলো বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। এদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেই নেমে আসত কাঁটাবন মসজিদের সামনের রাস্তায়, চলত গাড়ি ভাংচুর, জালাও পোড়াও। আমরা উল্লসিত দর্শক। রাস্তায় গাড়ি পুড়ছে এমন আলামত দেখা গেলেই দ্রুত সবার কাছে সংবাদ পৌছে যেত, নারী পুরুষ ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে সবাই মুহুতের্র মধ্যে ছাদে। যত বেশী গাড়ি পোড়ে ততই বেশী উত্তেজনা। যেদিন গাড়ি পোড়ে না সেদিন জনজীবনে গভীর হতাশা। এক পর্যায়ে পুলিশ আসত, তারপর কিছুক্ষন পুলিশের সাথে প্রথমে গালাগালি, এরপর ইটাইটি, লাঠি চার্জ, কখনো বা গুলি। ৮৭ সালের নভেম্বরে আন্দোলন তখন দানা বেঁধে উঠেছে। সবাই মোটামুটি নিশ্চিত যে এবার আর এরশাদের রেহাই নাই, ক্ষমতা তাকে ছাড়তেই হবে। ১০ই নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। সবাই নিশ্চিত যে ১০ই নভেম্বর ফাইনাল শোডাউনের পর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ছে। এ উপলক্ষ্যে খুব সম্ভব্ত ৩ দিনের টানা হরতাল দেওয়া হয়েছে। সে সময় ২ দিন ৩ দিন এই রকম টানা হরতাল দেওয়া হত।
এমনই উত্তাল সময়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী নূর হোসেনকে ঠিক করে রঙ লাগিয়ে আন্দোলনের সামনে নামানোর জন্য। ১০ই নভেম্বর ৮৭ সালের ঐ দিনটিতে নূর হোসেনকে কারা গুলি করেছিলো, তা যেমন আজ জাতির কাছে পরিষ্কার; তেমনি পরিষ্কার রাজনীতির এই মাঠে নূর হোসেনদের জীবন নিয়ে খেলার বিষয়টিও। আর এই খেলায় সেদিন এরশাদের পতন হয়নি, প্রান গিয়েছিলো শুধু নুর হোসেন সহ আরো কিছু নিঃস্বার্থ গনতন্ত্রকামী মানুষের; এখন যেমন যাচ্ছে সাধারণ মানুষ আদম আলী, রহম আলী আর জামায়াত-শিবিরের অথর্বগুলোর। এরা রাজনীতি করতে এসে রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। আর সেই শিকারকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত বারবার ড়্গমতায় আসে।
ইতিহাস বলে সেলিম দেলোয়ার, বসূনিয়া, দিপালী সাহা, নুর হোসেন, জিহাদ, ডাঃ মিলনদের রক্তের উপর দিয়ে আজ যারা রাজনীতি করতে করতে ক্ষমতায় আসেন; তারা কেবলই মুখে বলেন দেশ ও মানুষের কথা। কাজে এরা রাজনীতিকে ব্যবহার করেন নিজেদের উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে। যদিও এই কালচারটা শুধু বাংলাদেশেই নয়; সারা বিশ্বেই আছে। তবে তারমধ্যে যদি অংক করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়; প্রথম ভারত তৃতীয় পাকিস্তান। অবশ্য এই বিষয়টিতে ভারত-ই সবার গুরম্ন।
সে যাইহোক, ক্ষমতার রাজনীতিতে দক্ষ খেলোয়াড়দের রাজনৈতিক মাঠ আওয়ামী লীগের দখলে যায় একবার; আবার বিএনপি-জামায়াতের দখলে। এমনি করে একজন দক্ষ সরকারের পতনের পর থেকে চলেই আসছে। অবশ্য সে সময়
পথ তৈরী হয়েছিল ক্ষমতা বদলের, একসময় স্বৈরাচারী এরশাদকে যেতে হয়েছে ঠিকই। তবে বদল হয়েছে শুধু শাসকের। শাসক গিয়ে আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ে শোষক। শোষণ করতে করতে তৈরি রাজনৈতিক দল বিএনপি পারলে একরাতে পুরো দেশ খেয়ে ফেলে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগেরও একই হাল। যে কারনে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বারবার সৈরাচার-সৈরাচার বলেও আওয়ামী লীগ তাদেরকে নিয়েই ৫ বছর কাটিয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ যখন-ই জোট ছাড়বো বলে তখন-ই আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে আবারো সাথে রাখে।
মাঝখানে পুলিশ বাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলিতে প্রাণ হারানো নুর হোসেনের ভাইর মত লোকেরা চাকুরী পায়; কোটি কোটি টাকার মালিক হয়। জিরো পয়েন্টে নিহত নূর হোসেনের স্মৃতিতে ফুল দেয়া হয়। বলা হয়, ‘সেদিন নিজের বুকে-পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” শ্লোগান লিখে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। সেই থেকে ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।নুর হোসেন শহীদ হওয়ার পরে আন্দোলন আরও জোরদার হতে হতে দীর্ঘ ছয় বছর পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয়েছিল সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের।’
এই তো ব্যাস, সকল দায়িত্ব পালন শেষ করে আবার সেই এরশাদের সাথেই বৈঠক-নির্বাচনী আলাপ ইত্যাদি। যদি তাই হয়, তাহলে আর এত কাহিনী কেন? কেন এত মৃত্যু? ৮৭ তে একজন নূর হোসেনের বদলে এখন প্রায় প্রতিদিন-একজন করে নূর হোসেন শহীদ হচ্ছে। এই অভাগা নূর হোসেনদের মৃত্যু থামাতে তৈরি হতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন প্রতিটি তরুণকে। যারা ভালোবাসে দেশকে, ভালোবাসে দেশের স্বাধীনতাকে, ভালোবাসে দেশে মানুষকে-মাটিকে…
মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট/