সোহেল রানা, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

বাকরুদ্ধ অগ্নিদগ্ধে নিহত ঝুমার পরিবার। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় ঝুমার লাশ বহনকারী গাড়ি কমলগঞ্জের বৃন্দাবনপুর গ্রামে পৌছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। কন্যা হারানো শোকে ঝুমার মা বাবা ঘটনার পর থেকেই শোকে পাথর হয়ে আছেন। লাশ বাড়িতে পৌছার পর তাদের কান্না আর তিন বোনসহ আত্মীয় স্বজনদের বিলাপে উপসি’ত লোকজন কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।

নবপরিহিতা ঝুমা রাণী শীলের পুরো শরীরই ছিল অগ্নিদগ্ধ। ঝুমার লাশ নিয়ে শুক্রবার রাতে গ্রামে পৌছার সংবাদ পেয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পারভীন আক্তার লিলি, স’ানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ চৌধুরী, রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেলিম নেওয়াজ এর উপসি’তিতে ঝুমার মরদেহ গ্রহন করেন ঝুমার আত্মীয় স্বজন।

যৌতুকের টাকা ও শ্বশুর বাড়িতে রেখে যাওয়া বাইসাইকেলের জন্য স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের আগুনে অগ্নিদগ্ধ ঝুমার লাশ আসার সংবাদ পেয়ে শুক্রবার রাতে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিনিক মিডিয়ার উপজেলা ও জেলা প্রতিনিধিগণ হাজির হন ঝুমার বাড়িতে। কথা বলার চেষ্টা করা হয় ঝুমার বাবা মার সাথে। কিন’ কথা বলা সম্ভব হয়নি। উঠানে বিলাপ করতে করতে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তারা। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলেও ফ্যান ফ্যান করে ঝুমার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখন কথা বলার চেষ্টা করলেই বিলাপ করে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েন মাটিতে।

রাতে লাশ বাড়ি পৌছার পর আশপাশের হিন্দু মুসলিম সব সমাজের নারী পুরুষসহ শিশুরা ঝুমাকে একনজর দেখতে ভীড় করেন ঝুমার বাড়িতে। ধর্মীয় সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পারিবারিক শ্বশানে শেষকৃর্ত্য সম্পন্ন করা হয়।

ভালবাসার সম্পর্কে গত ১৬ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে সনাতনী শাস্ত্রীয় মতে রাজনগর উপজেলার টুপিমহল গ্রামের মৃত গোপি চন্দ্র শীলের ছেলে গৌবিন্দের সাথে বিয়ের হয় ঝুমার। বিয়ের পর গোবিন্দের বাড়ি থেকে আসা ইউপি সদস্য রফিক মিয়া, তার দুই বোনের জামাই কৃপেশ শীল, নিখিল শীল, খালাতো ভাই শন’ শীলসহ অন্যান্যরা নববধূ ঝুমা রাণী শলসহ গৌবিন্দকে নিয়ে যান। কিন’ এ বিয়ে মেনে নিতে পারেননি গৌবিন্দের মা মালতি রাণী চন্দ্র শীল ও বাড়িতে থাকা অবিবাহিত বড় বোন বিপ্লবী রাণী চন্দ্র শীল।

বিয়ের পরদিন থেকেই চলে ঝুমাকে নানা কষ্ট নিপিড়নের কাজ। ঝুমার বাড়িতে রেখে যাওয়া পুরাতন বাইসাইকেল আর নগদ ১লাখ টাকা যৌতুকের জন্য স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির অমানুষিক নির্যাতন চলে ঝুমার উপর। ঝুমার সাথে প্রায় প্রতিদিন শ্বাশুরি আর স্বামীর বড় বোনের ঝগড়া ও নির্যাতন চলতে থাকে। এক সময় এ মাত্র বেড়ে যায় বলে ঝুমার শ্বশুর বাড়ির এক প্রতিবেশী জানান। মারধোরের মাত্রার এ নির্যাতন বাড়ার পর ৩০ ডিসেম্বর ঝুমাকে নির্যাতন করে ঘরে আটকে রাখা হয়।

এ অবস’ায় ঝুমা ২দিন অনাহারেও ছিল বলে ওই প্রতিবেশী জানান। এ অবস’ায় বিয়ের ১৬ দিনের মাথায় গত রোববার দুপুরে নির্যাতনের এক পর্যায়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এ অভিযোগ ঝুমার পরিবারের। তবে ঝুমার শ্বশুর বাড়ির সদস্যের দাবী ঝুমা নিজেই ঘর থেকে কেরোসিন ও ম্যাচ নিয়ে লেট্রিনে গিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ গৃহবধু ঝুমা রাণী শীলকে স’ানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ও পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ঝুমার শারীরিক অবস’ার অবনতি ঘটলে রোববার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে স’ানান-র করা হয়।

অগ্নিদগ্ধের এ ঘটনা ঘটলেও ঝুমার পরিবারকে এ সংবাদ দেওয়া হয়নি। ঝুমার শ্বশুর বাড়ির এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে ঝুমার আত্মীয় স্বজন টুপিমহল শ্বশুড়ালয়ে ছুটে গেলেও ঝুমার সন্ধান পাননি তারা। ঘটনার পর দিন বিকালে ঝুমার কাকা তরনী চন্দ্র শীল ঝুমার স্বামী গৌবিন্দ,বড় বোন বিপ্লবী ও শ্বশুরি মালতিকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধনী ২০০৩এর ১১ক/৩০ ধারায় রাজনগর থানায় মামলা করলে ওইদিন রাতেই পুলিশ ঝুমার শ্বাশুরিকে আটক করে পুলিশ।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস’ায় গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে ঝুমা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে হাসপাতালে ঝুমার লাশ রেখে স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির লোকজন পালিয়ে যান। কমলগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পারভীন আক্তার ও পতনউষার ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ চৌধুরী স্বামীসহ অন্য আসামীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান করতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবী জানান।

রাজনগর থানার ওসি সেলিম নেওয়াজ বলেন, প্রাথমিকভাবে এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী শ্বাশুড়ি মালতী চন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকী আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। রোববার আদালতে আটক আসামী ঝুমার শ্বশুরিকে রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে তিনি জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here