চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য>

144এখন আর ‘কর্ষিকা’র উপরেও ভরসা করছেন না রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। তিনি নিজে সমস্তকিছু দেখতে চান। নিজের চোখে। মাউসের এক ‘ক্লিকে’ই তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধুমাত্র তাঁরই প্রশাসনিক নজরদারির জন্য বিশেষ এক ধরনের সফটঅয়্যার শীঘ্রই চালু হতে চলেছে সরকারের শীর্ষমহলে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমীক্ষা’।

য়তো কথার কথা। কিন্তু তিনি বলেন, তাঁর নজর সর্বত্র। তাতেই ধরা পড়ার ভয়ে তটস্থ থাকে প্রশাসন। সিঁটিয়ে থাকেন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারাও। কারণ, তাঁরা জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজস্র ‘কর্ষিকা’। সময়ে-অসময়ে তিনি সেগুলিকে সক্রিয় করে তোলেন। কখনও দলীয় স্তরে। কখনও প্রশাসনিক। ফলে খবর পৌঁছতে তাঁর কাছে দেরি হয় না।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন আর ‘কর্ষিকা’র উপরেও ভরসা করছেন না রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। তিনি নিজে সমস্তকিছু দেখতে চান। নিজের চোখে। মাউসের এক ‘ক্লিকে’ই তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধুমাত্র তাঁরই প্রশাসনিক নজরদারির জন্য বিশেষ এক ধরনের সফটঅয়্যার শীঘ্রই চালু হতে চলেছে সরকারের শীর্ষমহলে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমীক্ষা’।
প্রাথমিকভাবে পূর্ত দফতরের জন্য এই সফটঅয়্যার তৈরির কাজ চলছে। অর্থাৎ, সর্বাগ্রে ‘দিদি’র ‘নজরবন্দি’ হলেন তাঁর আস্থাভাজন পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। পরে অবশ্য সমস্ত দফতরেই এটি চালু হওয়ার কথা। ফলে কালক্রমে কোনও ভাইবোনই বাদ পড়বেন না।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা, প্রযুক্তিটির দু’টি দিক রয়েছে। প্রথম ভাগে বাছাই করা পদাধিকারীদের ডেস্কটপে ‘সমীক্ষা’ সফটঅয়্যারটি থাকবে। দ্বিতীয় ভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের স্মার্টফোনে সেটি থাকবে ‘অ্যাপ’ হিসাবে। ‘সমীক্ষা’য় মাউসের ক্লিক হলেই গোটা রাজ্যে পূর্ত দফতরের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ ফুটে উঠবে। তথ্য পাওয়া যাবে জেলা, ব্লক, এলাকা ভাগ করে কোথায় কী ধরনের কাজ চলছে তার। প্রকল্পগুলি কী পর্যায়ে রয়েছে, কোথায় কী সমস্যা, কাজ শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা-ও জানা যাবে ‘সমীক্ষা’ থেকে।
মোবাইলের সংশ্লিষ্ট ‘অ্যাপ’টি ব্যবহার করবেন একেবারে তৃণমূল স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্ত দফতরের অফিসারেরা। সংশ্লিষ্ট আধিকারিক যে প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁকে সময় সময় প্রকল্পের কাজ খতিয়ে দেখতে হবে। এমনকী, মোবাইলে কাজের অগ্রগতির ছবি তুলে তা ‘আপলোড’ করতে হবে ‘সমীক্ষা’র জন্য। সেখানেও চমক! ছবি তোলার সময় সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের প্রকৃত ‘অবস্থান’ও জানতে পারবে নবান্ন। ছবি তোলার সময় সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের অবস্থানের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশও নথিবদ্ধ হয়ে যাবে ‘সমীক্ষা’য়। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘জিপিএস থাকায় অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশই প্রমাণ করবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের অবস্থান। তিনি নিজে প্রকল্পের কাছে গিয়ে ছবি তুলেছেন না কি আগের কোনও ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন, তা-ও প্রমাণ হয়ে যাবে। ফলে গাফিলতি দেখালে আমরা সহজে তাঁকে চেপে ধরতে পারব।’’
প্রশাসনের অন্দরের খবর, সাধারণভাবে দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে ‘সমীক্ষা’। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীও তাঁর ইচ্ছেমতো এটি পরখ করে দেখতে পারবেন। এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, এখন মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে কোনও প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্য চেয়ে পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে তা দেওয়া কঠিন হয়। প্রথমে দফতরের ফাইল দেখতে হয়। তার পরে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের কাছে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ যায়। তিনি আবার স্থানীয় আধিকারিকদের থেকে তা সংগ্রহ করে পাঠান। তার পরে তৈরি হয় রিপোর্ট। সময়সাপেক্ষ ওই পদ্ধতির পরিবর্তে ‘সমীক্ষা’ থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী।
হঠাৎ কেন এই ব্যবস্থা?

প্রশাসনের অন্দরে ব্যাখ্যা দু’টি। এক, দ্বিতীয় তৃণমূল সরকারে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সমান্তরালভাবে বেড়েছে তাঁর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অংশীদার পূর্ত দফতর। কারণ রাস্তা, সেতু-সহ পরিকাঠামো তৈরির কাজ নিজের চোখে দেখতে পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। গ্রামীণ রাস্তার উন্নয়ন, নতুন রাস্তা তৈরি, খারাপ রাস্তার সংস্কার করে গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন বোঝা গিয়েছে। যার সুফল সরাসরি গিয়েছে শাসকদলের অনুকূলে। আগামী পাঁচ বছর ওই গতি আরও বাড়াতে চান মমতা। পরিকাঠামো স্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার নিবিড় ব্যবহারও চান। কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ অগ্রগতি জানা থাকলে পরিকল্পনা করতে তাঁরও সুবিধা হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রথম দফার শাসনকাল থেকে এখখনও পর্যন্ত ১২৮টি প্রশাসনিক বৈঠকের প্রতিটিতে সড়ক পরিকাঠামোর পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা সময় দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কখনও প্রশংসা করেছেন। কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ, তাঁর হস্তগত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক ছিল। খরচের দিকেও মমতা আলাদা করে গুরুত্ব দিচ্ছেন। রাজ্য এমনিতেই অর্থসংকটে। তার উপর নিজস্ব তহবিল থেকে পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয়বরাদ্দ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় অনুদানের সুষ্ঠু ব্যবহার করা গেলে কাজ আরও উন্নত হওয়ার কথা। এক কর্তার কথায়, ‘‘কোনও প্রকল্পের জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে, জেলা স্তর থেকে তা বাড়ানোর প্রস্তাব এলে ‘সমীক্ষা’র মাধ্যমে প্রকল্পের পরিস্থিতি যাচাই করা যাবে। প্রয়োজনে কীভাবে সাশ্রয় করা যায়, তারও রূপরেখা তৈরি করা যাবে। আখেরে লাভ হবে কোষাগারের।’’

রাস্তার হাল জানতে গত বছর পূর্ত দফতরের কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারকে ১৩ দিনে প্রায় ১৬ হাজার কিলোমিটার ‘দৌড়’ করিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি জেলার কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার হালহকিকত খুঁটিয়ে দেখার জন্যও ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বন্যার ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বৈঠক করেছিলেন মমতা। তাঁর নির্দেশ ছিল, রাজ্যের সব জেলায় ঘুরে পূর্ত দফতরের অধীন রাস্তার অবস্থা এবং সেগুলির ‘ভবিষ্যৎ’ নির্ধারণ করতে হবে দফতরের সচিবকে। প্রশাসনের একাংশের ব্যাখ্যা, নিজের প্রতিনিধি হিসাবে সচিবকে জেলাসফরে পাঠিয়ে কাজ আরও ‘জোরদার’ করতে চেয়েছিলেন মমতা। তাঁকে সঠিক তথ্য দিতে ‘বাধ্য’ হয়েছিলেন এলাকাভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারেরা। এক কর্তার কথায়, ‘‘মোদ্দা বিষয় হল, প্রথম তৃণমূল সরকারে সচিবের চোখ দিয়েই গোটা রাজ্যে পূর্ত দফতরের অধীনস্থ রাস্তার হাল বুঝেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়বারে নিজের চোখে সব দেখতে চান!’’
তবে এর ফলে যে বিভিন্ন দফতরের উপর ‘চাপ’ আরও বাড়বে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী এবং আমলারা। এমনিতেই প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্প ধরে ধরে সংশ্লিষ্ট জেলা এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরের আমলাদের কাজের খতিয়ান নেন। কাজের কাজ না-হলে ধমকচমকও জোটে। তবু একটা ‘ফাঁক’ থাকে। নীচুতলার উপর দায় চাপিয়ে কখনও-সখনও পার পাওয়া যায়। এবার তারও কোনও সুযোগ থাকছে না।
‘দিদি’র চোখের ‘পাওয়ার’ বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও আছে বইকি!

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here