– তাহমিনা শিল্পী।

imagesoআজকাল চশমা পড়েও বাবা আগের মত পরিষ্কার দেখতে পায়না।ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে জানালেন এক চোখে ছানি পড়েছে।অন্যচোখেও সম্ভাবনা আছে।দ্রুত অপারেশন করিয়ে ছানি কাটিয়ে নির্দিষ্ট পাওয়ারের চশমা দিলাম।
বাবাকে খুব কঠিন করে শাসন করে বললাম– বেশি বেশি কাঁদলে চোখে ছানি পড়ে!তোমারতো আবার আজকাল কথায় কথায় চোখে জল চলে আসে।আর কখনো যেন চোখে জল না দেখি।
বাবা হাসে আর বলে-তাহলে তুইও আর বাবাগিরি করিসনা।
আমি বলি-একটা সময় তুমি-ই কি আর কম করেছ?এখন সময় আমার দখলে চুপকরে শুধু দেখে যাও।

শুনে বাবা হাসে কিন্তু চোখ ভিজে উঠে।
অস্ফুটে বলে- “পাগলী কোথাকার!”
আমি তবুও বাবাগিরি করি,রোজ রোজ করি। আর রোজই বাবার চোখ ছলছল করে।কখনও কখনও চোখ গলিয়ে সে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নেমে আসে।মিথ্যে বলবনা বাবার চোখের এই জল দেখতে আমার বেশ লাগে!
ছোটবেলায় বাবা আমার হাত ধরে হাঁটিহাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখিয়েছিল।এখন আমি উঁচু-নিচু পথ চলতে,সিঁড়িতে,রিক্সায়-গাড়িতে উঠতে-নামতে কিংবা রাস্তা পারাপারের সময় মনের অজান্তেই বাবার হাত ধরে ফেলি।বাবা লাজুক দৃষ্টিতে তাকায়।
বলে-পারবো আমি।
তবে বুঝতে পারি ভরসা পায় অনেকটা।
সেসময়ে আমরা একাই স্কুলে যাওয়া আসা করতাম।অভিভাবককে সঙ্গে যেতে হতনা।তবে ছুটির পর অনেকদিনই দেখতাম বাবা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।স্কুলের সামনে যে মিষ্টির দোকান ছিল বাবা আমাকে সেখানে নিয়ে মাটির ভাড়ে দই খাওয়াতেন।মাটির ভাড়ের ওই দইটা তখন আমার পছন্দের খাবারের তালিকায় প্রথমদিকেই ছিল।বাবাকে কখনও বলিনি।কিন্তু কি করে যেন বুঝে গিয়েছিল।
আমি দই খেতাম।বাবা আমার উল্টো দিকের চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে আমার মুখের দিকে অদ্ভুত ভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।

অনুরোধ করে বলতাম- দইটা খুব মজা,তুমিও খাওনা!

কিন্তু বাবা কখনো খেতো না।একা একা খেতে আমার খারাপ লাগতো।চামচে করে দই তুলে বাবার মুখের কাছে ধরতাম।বাবা হেসে হেসে খেয়ে নিতো।চোখের কোনে জল জমে উঠতো।

তখন ভাবতাম হয়ত বাবার কাছে ওতো টাকা নেই।কিংবা দই খেতে পছন্দ করেনা।কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছিলাম দই বাবারও খুব পছন্দের খাবার।

এখন আমি বাবাকে নিয়ে বাইরে কোথায় গেলে সামনে মিষ্টির দোকান পেলেই দই খেতে নিয়ে যাই।আমি বাবার মত করেই গালে হাত দিয়ে তার খাওয়া দেখি।কি তৃপ্তি করে বাবা দই খায়!দেখে আমার ভীষন ভালো লাগে।

বাবা বলে- খেয়ে দেখ একটা দই,খুব মিষ্টি।

কিন্তু আমি খাইনা।বুঝতে পারি বাবা কেন তখন নিজে না খেয়ে অমন করে আমার খাওয়া দেখত।
বাবা চামচে দই তুলে আমার মুখের সামনে ধরে।আমি চুপচাপ খেয়ে নেই।বাবার হাত থেকে খেতে কি যে ভালো লাগে! মনে কি যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায় সে কেবল আমিই জানি।

যখন ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম বাবার সে কি আনন্দ।আমাকে একটা নীল রঙের উপর সোনালী নকশি করা ফাউন্টেন পেন উপহার কিনে দিল।আমার খুব পছন্দ হয়েছিল কলমটি।কিন্তু দু’দিন না যেতে স্কুলে ক্লাস থেকে হারিয়ে গেল।

কি আশ্চর্য!চাইতে হলনা,আমার মন খারাপ দেখে সেদিনই ঠিক ওই রকম একটি কলম আবার আমায় এনে দিল।

এখন বাবা প্রায়ই চশমা হারিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরে।আমি চশমা কিনে দিয়ে বাবার ঝাঁপসা চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখে আনন্দিত হই।

যখন বিকেলে পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতাম।

বাবা শাসন করে বলত- বেশি দুরে যাবিনা,দেরী করবিনা।মাগরিবের আযান পড়ার সাথে সাথে ঘরে ফিরে পড়তে বসে যাবি।

আমিও কিন্তু কম যাইনা!এখন বাবা যখন রোজ বিকেলে হাঁটতে যায়।

আমি কড়া করে শাসন করে বলে দেই- একদম দুরে যাবে না কিন্তু,দেরী করবেনা।ঠিক করে ঔষধগুলো তো খেতে হবে নাকি!
বাবা হাসে আর পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মোছে।
আমার ছোটবেলায় বাবা যখন অফিসের কাজে বাইরে কোথাও যেত,বাড়ী ফেরার সময় হাতে করে এটা-সেটা নিয়ে আসত। আমি অপেক্ষায় থাকতাম বাবার ফেরার সেই দিনটির জন্য।অনেক জিনিস পেয়ে খুশি হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম।
তেমন করেই আমি যখন কিছু নিয়ে এসে বাবার হাতে দেই।

খুব রাগ দেখিয়ে বলে- কি দরকার ছিল শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার!

বাবার ছলছল চোখ দেখে আমি বুঝি তার ভীষন আনন্দ হচ্ছে।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময়,ঈদে বাবা আমার হাতে আলাদা করে কিছু টাকা দিয়ে বলত-যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নিস।
আমিও বাবাকে তেমন করে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলি- কাছে রেখে দাও।তোমার প্রয়োজন মত খরচ কোরো।

বাবা কপট রাগ দেখিয়ে বলে- আমার আবার আলাদা করে খরচ কিসের।সবই তো আছে।রেখে দে তোর কাজে লাগবে।

কিন্তু বরাবরের মতই বাবার চোখে দেখি আনন্দাশ্রু।ভাললাগায় আমি আবার ছোট্টটি হয়ে যাই।

 সত্যিই বাবা! কি ভালোই না ছিল আমার ছোটবেলাটা।তোমার জন্য বাবা! শুধু তোমার জন্যই।

যদি সম্ভব হতো আমি আবার ছোট হয়ে যেতাম।হাঁটতাম তোমার আঙ্গুল ধরে ধরে।গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই খেতাম দুজনে মিলে।ঈদের জামাতে যেতাম তোমার পাঞ্জাবির কোনা ধরে ধরে।
জানি আজ আর তা সম্ভব নয়।তাই আমার সাথে সবকটি মুহূর্ত তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যখন তোমার আনন্দিত মুখটা দেখি।প্রতিমুহূর্তে আমি যেন আমার শৈশবেই ফিরে যাই।

এই যে তোমাকে নিয়ে কিছু কথা লিখলাম, আমি জানি তুমি গর্বিত ভাবে পড়বে।তোমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটবে।আর চোখ ছাপিয়ে অঝোরে ঝরবে জল।আমিও তোমার গর্বিত হাসি হাসি মুখখানা আর জলে টইটুম্বর চোখ দু’টো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠবো।

আর মুখটাকে যারপরনাই কঠিন করে বলব- একদম কাঁদবে না।

তুমি বলবে- ফের বাবাগিরি!

খুব ভালো থেকো বাবা তুমি।তোমাকে ছাড়া আমার একটি দিনও ভাবতে পারিনা।তুমি বেঁচে থাকো অন্তত আমার মৃত্যু পর্যন্ত।
দেখলাম দু’ফোটা জল আমার চোখের পাঁপড়ি বেয়ে টুপ করে পড়ল আমার লেখার ডায়েরিটার উপর।

 tahmina_shilpi@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here