আজকাল ভালোবাসাও হয়ে গেছে ফেসবুক নির্ভর। রিলেসানশিপ স্ট্যাটাসটা পরিবর্তন করতেই যেন প্রেমে পড়া। প্রেমও সহজ আর সস্তা হয়ে গেছে। দুদিন ফেসবুকে চ্যাটিং সপ্তাহ পরে ফোনালাপ দুই সপ্তাহ পরে দেখা তারপর এখানে সেখানে চেক ইন আর ভালবাসার পোস্ট মাস খানেক পরে ব্রেকআপ। আবারও নতুন কারু খোঁজ।
নূসরাত ইমা :: আমার ছেলেবেলার কথা ভাবলে আর এখনকার বাচ্চাদের ছেলেবেলা দেখলে মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা ছিলাম দুরন্ত। মাঠে বাধাহীন দৌড়া দড়ি করে কেটেছে। পুরো পাড়াটা ছিলো নিজের বাড়ির মত। পাড়ার সবাই ছিলো আপন আত্মিয়র মত।
আজ কাল সব কিছুই অন্যরকম। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তাও অনেকে জানে না। মাঠে দৌড়ানো দূরে থাক ঘর থেকেই বেরুনোর জায়গা নেই আজ কাল। বেশিরভাগ শহুরে শিশুই খেলা বলতে বুঝে ভিডিও গেমস, মোবাইল গেমস ইত্যাদি। গোল্লা ছুটের নামই হয়তো শুনেনি কিন্তু ক্ল্যাস অফ ক্লান এর নাম ঠিক জানে। এ প্রজন্ম ফেসবুক প্রজন্ম।
সেদিন টিভি খুলতেই দেখলাম একটা মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বিজ্ঞাপন চলছে। তার ভাষাটা হলো এমন- নেট মানে ঘুম ভেঙ্গে পাখিটার মুখ, নেট মানে সেলফি যখন তখন, নেট মানে ভিডিও আপ সারাক্ষণ। অন্য একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম মেয়েকে বাবা পাত্র দেখাচ্ছে। ছেলে লন্ডনের এমবিএ, রান্না পারে, নাচতে গাইতে পারে মেয়ে রাজি হয়ে বলল ঠিক আছে তাহলে সেলফি তুলি। দুর্ভাগ্য ছেলের কাছে সেলফি তোলার মত ফোন নেই তাই হল না বিয়ে। এমন গাদা গাদা বিজ্ঞাপণ আছে যার ভাষা এবং কনসেপ্ট দেখে মনে হয় আমারা আসলে কোন জামানায় বাস করছি।
ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপন কি অন্যভাবে করা যায় না? ইন্টারনেট কি মানুষ শুধু প্রেম করা সেলফি তোলা আর যা তা ভিডিও আপলোডের জন্যই ব্যাবহার করে? আমাদের নির্মাতারা কি এমন কোন কনসেপ্ট খুঁজে পেলেন না যেটা কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা দিবে দারুন কিছু করার ব্যাপারে। অবশ্য পুঁজিবাদী সমাজে যেটা বেশি চলে সেটাইতো বিজ্ঞাপনের ভাষায় উঠে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। তবুও আমাদের কি আরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত নয় ?
এখন ছেলে বুড়ো যে রোগে আক্রান্ত তার নাম সেলফি। যে যেখানে পারছে যেভাবে পারছে সেলফি তুলছে। রাস্তায় গাড়ি আসছে তার হুঁশ নেই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলায় ব্যাস্ত। কোথাও আগুন লেগেছে সাহায্যের জন্য যাবে তা না সেলফি তোলায় ব্যাস্ত। এর সাথে যোগ হয়েছে ফেসবুক স্ট্যাটাস। সেলফির সাথে ফেসবুকে অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজি পোস্ট দিতেই হবে ফিলিং OMG বা এই এমন কিছু।
সেদিন দেখলাম একজন নামাজে সেজদা দিচ্ছে আর সেলফি তুলছে। বলছি না যে সবাই এটা করছে কিন্তু অনেকেই এটা করছে। আর ভয়ের ব্যাপার হলো এটা বেড়ে চলেছে। সেলফি তুলতেই পারি আমরা কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বিচার করে সেলফি তোলা উচিত তাই নয় কি?
এই যে বিজ্ঞাপনের ভাষা, অহেতুক সেলফি তোলা এই সবকিছুরই পেছনে যেটা কাজ করে তা হলো সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক। এমনকি এটা আজকাল আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দারুন প্রভাব ফেলছে। আজ কাল বিয়ে বলুন আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান বলুন দেখবেন সবাই অদ্ভুত ভাবে সেজে আছে। একটা আলাদা মঞ্চই তৈরি করা হয় সেলফি আরা ছবি তোলার জন্য। আগে বিয়ে ছিলো দুই পরিবারের বন্ধন আর আপ্যায়নের অনুষ্ঠান। আজকাল এটা হয়ে গেছে বর বউ এবং অন্যদের অদ্ভূত ভঙ্গিমায় ছবি তোলার অনুষ্ঠান।
কে কি খেলো, কে কেমন আছে, তা খোঁজ নেয়ারচে আগে ছবি তোলা জরুরি হয়ে গেছে। একজনের সাথে ছবি তুলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কারু সাথে ছবি তোলার জন্য। আগে ভাবতো অনুষ্ঠানের খাবারের রান্নার মান খারাপ হলে মান ইজ্জতের ব্যাপার এখন ভাবে ওয়েডিং প্লানার কে দিয়ে বিয়ের মঞ্চ না সাজালে আর নামি দামি ফটোগ্রাফার কে দিয়ে ছবি না তোলালে ইজ্জত থাকবেনা তা সে ধার করে হলেও।
বন্ধু বান্ধব বা আত্নিয় সজনের সাথে কোথাও খেতে গেছি? সবাই ব্যাস্ত চেক ইন দেয়ায়। তারপর শুরু সেলফি তোলা। কি খেল কি কথা বলল সে দিকে খবর নেই। তারপর ব্যাস্ত হয়ে যায় সেইসব ছবি আপলোড দেয়াতে। এরকম সামাজিকতাকে কি, সামাজিকতা বলে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিনিয়ত আমাদের অসামাজিক করে তুলছে। আমাদের ফেসবুকে হাজারটা বন্ধু কিন্তু যখন সত্যিই কারু সাথে কথা বলতে চাই আমরা একজন বন্ধুও খুঁজে পাই না। আগে যাদের সাথে ভার্চুয়াল লাইফ এর চেয়ে এর বাইরের জীবনে মানে সত্যিকারের জীবনে দারুন বন্ধুত্ত ছিল সেটা যখন বাস্তবের চে ভার্চুয়ালের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায় তখন ভার্চুয়ালের মায়া ভুবনে তাদের সাথে একটা সময় দূরত্ব তৈরি হয়।
অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝিও সৃষ্টি হয়। এরকম নজিরতো কম নয় যে অতি মাত্রায় ফেসবুক আসক্তি নান রকম সম্পর্কের অবসান ঘটিয়েছে। ফেসবুকে হয়তো কেউ খুব খুশি খুশি একটা ইমেজ তৈরি করেছে। সবাই ভাবছে তার জীবনটা বুঝি স্বপ্নের মতো। বাস্তবে হয়তো সে তার না পাওয়া গুলো লুকাতে চাইছে। একটা সময় যখন তার ফেসবুক আর বাস্তবতা মিলাতে পারে না সেটা তার জন্য চরম হতাশার হয়। এই হতাশা তখন তার ভালোরচেয়ে খারাপ-ই করে। অতিরিক্ত ফেসবুকাসক্তি মানুষের সৃজনশীলতার উপরও বিরুপ প্রভাব ফেলে। এই সবই আমরা জানি তাও আমরা বাস্তব জীবন থেকে এই ভার্চুয়াল মায়াকেই বেশি প্রাধান্য দি।
আজকাল ভালোবাসাও হয়ে গেছে ফেসবুক নির্ভর। রিলেসানশিপ স্ট্যাটাসটা পরিবর্তন করতেই যেন প্রেমে পড়া। প্রেমও সহজ আর সস্তা হয়ে গেছে। দুদিন ফেসবুকে চ্যাটিং সপ্তাহ পরে ফোনালাপ দুই সপ্তাহ পরে দেখা তারপর এখানে সেখানে চেক ইন আর ভালবাসার পোস্ট মাস খানেক পরে ব্রেকআপ। আবারও নতুন কারু খোঁজ।
ফেসবুক যে সব খারাপ কাজ করছে তা নয়। অনেক তরুন দারুন কিছু কাজ করছে। ফেসবুকে প্রতিবাদের কারনেই রাজন রাকিবের হত্যাকারিদের শাস্তি হয়েছে। ফেসবুকেই অদম্য বাংলাদেশ, মানবিক, লাইট অফ হোপ, লেপিং বাউন্ডারির মত আরও অনেক চমৎকার উদ্যগের যাত্রা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েই রানা প্লাজার নিচে চাপা পড়া মানুষের জন্য সাহায্য পৌঁছে গেছে। ফেসবুকেই ক্যাসপার এর জন্য সকলে এক হয়েছে। আর্য কে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে সবাই। শাহবাগ আন্দোলন ছড়িয়েছে ফেসবুকেই।
প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে তারা চাইলে পারে এই ফেসবুকেই দারুন কিছু করতে। তাহলে অহেতুক অযাচিত বিষয় গুলো না করে। অন্যের অনুকরন না করে চলুন না আমরা সবাই ফেসবুক কে চমৎকার কোনো উদ্যগের মাধ্যম বানাই। দেশের জন্যে ভালো হয় এমন কিছুতে ফেসবুকের নেটওয়ার্কিংকে কাজে লাগাই। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ বাস্তবেই বেশি হোক ফেসবুক যেন তাকে আর ধ্বংস করতে না পারে। let’s use facebook for a cause.
১০.০২.২০১৬
লেখকের ইমেইল: haider_nusrat@yahoo.com