KALAPARA PIC-04(19.06.2015)মিলন কর্মকার রাজু,কলাপাড়া(পটুয়াখালী) : “মৃত্যু আর বাঁধ ভাঙ্গার শেষ সীমানায় আমরা। আবার কবে স্রোতে ভাইস্যা যাই হেইয়ার ঠিক নাই। জোয়ার হইলেই ঘরে হাডু(হাটু) সমান পানি। জোবা (অমাবশ্যা-পূর্নিমা’র জোঁ’) হইলে তো ঘরেই থাহা যায় না। রাস্তাডাও ডুইব্বা যায়। কোনহানে যাওয়ারও উপায় থাহে না। গতো জোবায় মরতে মরতে বাইচ্চা গেছি। কিন্তু মানুষ আমাগো দুঃখ না দ্যাখলে আল্লায় আর কয়দিন মোগো বাচাইবে”। ত্রিশোর্ধ প্রতিবন্ধী মেয়েকে কোলে নিয়ে এ দূর্দশার কথাই জানালেন পঞ্চাশোর্ধ জাহানারা বেগম।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের নাওয়াপাড়া বিধ্বস্ত বাঁধ ঘেষা এই জাহানারার মতো শতশত পরিবার এখন মৃত্যুর খাঁদে শেষ আশ্রয় নিলেও প্রতিটি মুহুর্তেই তারা আশংকায় থাকছে কখন ভাসিয়ে নেয় রাড়্গুসে রাবনাবাদ নদী।

মাত্র আট বছর আগের কথা। নাওয়াপাড়া গ্রামের বাঁধের দুই পাড়ে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বাস ছিলো। ফষলের মাঠে ধান,সবজি উৎপাদন ও নদীতে মাছ শিকার করে হশি-খুশিতেই চলতো তাঁদের জীবন। শিশুরা স্কুলে যেতো। রোগবালাই হলে স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটে আসতো গ্রামে। অসুস্থ্য হলে সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যেতো পারতো। সুখী এ গ্রামের সুখ ২০০৭ সালের সিডরের জলোচ্ছাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে গোটা গ্রাম জুড়ে এখন শুধু কান্না ও হাহাকার।

নদী ভাঙ্গন ও জলোচ্ছাস তাঁদের চাষের জমি, বসত ঘর সবকিছুই গিলে খেলেও ত্রিশোর্ধ কল্পনা এখন রফিক হাওলাদার ও জাহানারা দম্পতির চিন্তার কারন। সুখী এ দম্পতির প্রথম সন্তান। অনেক স্বপ্ন ছিলো তাকে নিয়ে। তাই নাম রাখেন কল্পনা। মা ডাক শোনার আগেই তাঁদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, যখন জানতে পারেন কল্পনা প্রতিবন্ধী। এরপর আরও পাঁচ সন্তান হয় তাদের। তিন ছেলে মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। দুই ছেলে-মেয়েকে স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন। কিন্তু ত্রিশোর্ধ কল্পনা যেন এখনও শিশু। মাত্র আড়াইফুট উচ্চতার কল্পনার নেই হাঁটার শক্তি,কথাও বলতে পারেনা। ঝড়,জলোচ্ছাস হলে তাই কল্পনাকে কাঁধে করেই ছুটতে হয় জাহানারা বেগমকে। কিন্তু আর কয়দিন,তার নিজের বয়সও তো পঞ্চাশ পেড়িয়ে গেছে কান্নাজড়িত কন্ঠে এ কথা বলেন জাহানারা।

নাওয়াপাড়া বাঁধের শেষ সীমানায় জাহানারা বেগমের ঘর। স্যাতস্যাতে ঘর দেখিয়ে তিনি বলেন,এই দ্যাহেন সকালের জোয়ারে পানিতে সব তলাইয়া ছিলো। যহন জোয়ারের পানি ঢোহে মাইয়াডারে খাডের উপর উডাইয়া রাহি। গত ঝড়ের তো অরে লইয়া মাটির কিল্লায় ওডার সময় পানিতে পইড়্যা যায়। ভাগ্যিস পিছে এক বুড়া আছিলো। হে না ধরলে তো ভাসাইয়া লইয়া যাইতো। একটা হুইল চেয়ার হইলে তো ঠেইল্লা নেতে পারতাম। কিন্তু হেইয়ার তো অনেক দাম বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

এই গ্রামের চুন্নু হাওলাদার বলেন, মোরা তো আগে ভালোই ছিলাম। হেই আগে যদি ভাঙ্গা বাঁধটা ঠিক করতো তাইলে মোরা এইরহম ভাসতাম না। গত ৭ বছরে তিনবার বিলীন হয়েছে তাঁর বসত ঘর। এখন ভাঙ্গা বাঁধের ঠিক শেষ প্রানেত্ম আবার একটি ঝুপড়ি তুলেছেন। রাবনাবাদ নদীর প্রতিটি ঢেউয়ের ঝাপটায় ভেঙ্গে পড়ছে বাঁধের বিশাল বিশাল অংশ। সেই সাথে ভাঙ্গছে চুন্নু হাওলাদারের মতো শতাধিক পরিবারের স্বপ্ন। এখন মৃত্যু ও বাঁধ ভাঙ্গার শেষ প্রানেত্ম তারা।

বিধবা সাহাবানু (৭৫)। মাটির পাতিলে বাঁধের এক কোনে দুপুরের রান্না করছে। রান্না বলতে সিদ্ধভাতের সাথে আলু সিদ্ধ। শুধু জানতে চয়েছিলাম কেমন আছেন। দীর্ঘড়্গন চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,“ আমি আর কয়দিন বাঁচমু। এইহানে একটু শুকনো জায়গা দেহাইতে পারেন যে যেহানে আমারে কবর দেবে। আর হেই কবরডা থাকবে কয়েক বছর”। এই কথা যখন বলছিলো চোখের পানি ঝড়ে পড়ছে। তার জামাই আনোয়ার হোসেন বলেন,“তার শ্বাশুড়ীর আগে ৯/১০ কানি জমি আছিলো। তিন চাইরডা ঘর আছিলো। ৪/৫টা পুকুর আছিলো। গরু-মইষ আছিলো ৭০/৮০ ডা। আর এ্যাহন বান্দে (বাঁধে) থাহে। এই বান্দের এই কোনায় ঘর উডায় ভাঙ্গে। আবার অন্য জায়গায় উডায় ভাঙ্গে। এলাকার মানুষ যে কয়বার হ্যারে ঘর উডাইয়া দেছে, কিন্তু গাঙ্গে সব ভাইঙ্গা যায়।

ইউপি সদস্য দিলীপ গাজী বলেন, জোয়ার হইলে মানুষ গাঙ্গ হাতরাইয়া যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। নাওতে কইর‌্যা যাইতে হয়। গোটা গ্রামে ২/৩ ডা নাও আছে। হেইয়াতে আর কয়ডা মানুষ যাওয়া যায়। একটা মাটির কিলস্না আছে। হেইডায় ওটতে হয় হাতরাইয়া যাইয়া। বুড়া,গুরাড়া হেইডায় ক্যামনে যায় কন।’

লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, নাওয়াপাড়া গ্রামে মানুষ জোয়ার হইলেই ৩/৫ ফুট তলিয়ে থাকে। নাওয়াপাড়া আয়রন ব্রিজটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেখানে একটি কালভার্ট করলেও ১৫ দিনের মধ্যেই সেটাও পানির স্রোতে ভেঙ্গে যায়। প্রায় তিনশ ফুট ভাঙ্গা বাঁধে এখন বাঁশের সাঁকো দেয়া হলেও তাও নড়বড়ে।

কলাপাড়া পাউবো’র নির্বাহী প্রকেীশলী মো.আবুল খায়ের জানান, নাওয়াপাড়া বাঁধ সংস্কার শুরু হয়েছে। এই বাঁধ ঠিক হলেই জলাবদ্ধতা কমে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here