nur-hossainএম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি  :: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের প্রধান আসামী আওয়ামীলীগ নেতা নুর হোসেনকে কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের বারাসাত থেকে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে বলে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।

সূত্রে জানায় নূর হোসেন কে দেশে আনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার আইনী প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। এখন শুধুমাত্র গ্রীন সিগনাল পেলেই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরবেন নূর হোসেন।

এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন জানান, কয়েকদিনের মধ্যে নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তেমন তথ্য জানা নেই । তবে শীঘ্রই দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। আর বাকী আসামীদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

তবে, নুর হোসেন ছাড়া এখনো অধরাই থেকে গেল নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের এজহার ভুক্ত বাকী অপর ৫আসামী। এরই মধ্যে পার হয়েছে প্রায় এক বছর অথচ এজহারভুক্ত ৫আসামীর কেউই রহস্যজনক কারনে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।

আলোচিত ৭ খুনের প্রধান আসামী নুর হোসেন কলকাতায় গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে কিন্ত বাকী আসামীদের অবস্থান সম্পর্কে কোন ধারণা নেই পুলিশের কাছে। নিহত নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে ৫আসামীর মধ্যে ৪ জনই দেশের বাহিরে চলে গেছে ।

সিদ্ধিরগঞ্জের এলাকার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) একাধিক সূত্র জানিয়েছে ৭খুনের ঘটনায় নিহতের লাশ উদ্ধারের পরপরই এজহারভুক্ত আসামীরা গা ঢাকা দেয়। এর মধ্যে প্রধান আসামী নুর হোসেন ভারতে পালিয়ে পালিয়ে যান।

নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করে বলেন, র‌্যাবের সহায়তায় নুর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেছে। অন্য আসামীদের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি হাজী ইয়াসিন সিঙ্গাপুরে আমিনুল ভারতে পালিয়ে গেছেন।

প্রভাবশালী ঠিকাদার ও নূর হোসেনের ঘনিষ্ট হাসমত আলী হাসুর গ্রেফতার নিয়ে ধুমজাল সৃষ্টি হয়েছে যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন হাসু যশোর থেকে গ্রেফতার হয়েছে। কিন্ত হাসুর গ্রেফাতরের কোন সুনিদিষ্টি জবাব এখনো পায়নি নারায়নগঞ্জ পুলিশ ।

অন্য দুই এজহার ভুক্ত আসামী আশিকও ইকবালের ব্যাপারে সুনিষ্ট কোন তথ্য নেই পুলিশের কাছে। ভারতের কলকাতা একটি ফ্লাট থেকে গ্রেফতার হন ৭খুনের প্রধান আসামী নুর হোসেন। তার গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ভারত।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে । নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেনের নাম ও ছবি ইন্টারপোলে দেওয়া হয়েছিল।

ওই তথ্য মোতাবেক, কলকাতার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে ৭খুনের ঘটনায় নজরুলের দায়ের করা মামলায় এজহারভুক্ত ছয় আসামির সঙ্গে নিহত নজরুলের দীর্ঘদিন ধরে চরম বিরোধ কথা জানিয়েছে একধিক সুত্র।

নজরুলের পরিবারও প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছে ছয় আসামিকে গ্রেফতার করলেই হত্যা রহস্য উন্মোচিত হবে। আসামীরা দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। নদী দখল, দোকান ভাগ-বাটোয়ারা, অবৈধ বাণিজ্য, বিরোধপূর্ণ জমি কেনা-বেচা, পরিবহনে চাঁদাবাজি, শিল্পকারখানায় চাঁদাবাজি, ঝুটের অবৈধ বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করার অভিযোগ রয়েছে এই ছয় আসামির বিরুদ্ধে। বর্তমানে তারা পলাতক থাকায় অভিযোগ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী হন তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। নির্বাচনে নূর হোসেন জয়লাভ করেন। এরপর থেকেই তাদের মধ্যে শক্রতার সূত্রপাত।

নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নজরুল প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ওই সময়ে মামলার নথি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ সময় নূর হোসেনকে হত্যার চেষ্টা চালান নজরুলের সাঙ্গপাঙ্গরা। ‘৯৮ সালে একবার নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। এর পর থেকে নজরুল ইসলামকে কয়েক দফা হত্যার চেষ্টা চালান নূর হোসেন।

জানা যায়, ১৯৯১ থেকে ধীরে ধীরে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন নূর হোসেন। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে জেতার পর তার পরিচয় হয় ‘হোসেন চেয়ারম্যান’ হিসেবে। এরপর নিজেই সিদ্ধিরগঞ্জের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিতি পান। ‘

৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। শামীম ওসমান প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেন নজরুলকে। তবে নূর হোসেন জয়ী হয়ে হাত মেলান শামীম ওসমানের সঙ্গে।

নূর হোসেন ওই সময় স্থানীয় দুর্র্ধষ ক্যাডার মাকসুদ ও সারোয়ারকে নিয়ে গঠন করেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় নজরুলকে হত্যা করতে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করেও সফল হননি নূর হোসেন। তার ভয়ে এলাকাছাড়া হন নজরুল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।

মামলার দ্বিতীয় আসামি হাজী ইয়াছিন মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় না। নজরুল ইসলাম একসময় জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। নজরুল আগামী কাউন্সিলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ কারণে ইয়াছিনের সঙ্গে নজরুলের চরম বিরোধ তৈরি হয়।

মামলার তৃতীয় আসামি হাশমত আলী হাসু বিএনপির অনুসারী হলেও দলে তার কোনো পদ-পদবি নেই। হাসু সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলের সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে ঠিকাদারি করেন। নিহত নজরুলও সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে ঠিকাদারি করতেন। তবে হাসু বিএনপির অনুসারী হলেও তিনি ছিলেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজন। সড়ক ও জনপথে নূর হোসেনের নেতৃত্বে যারা ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসু তাদেরই একজন।

মামলার চতুর্থ আসামি আমিনুল ইসলাম রাজু সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা রয়েছে। নূর হোসেন সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য রাজু। নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় রাজুর সঙ্গেও নজরুলের বিরোধ ছিল চরমে।

মামলার পঞ্চম আসামি আনোয়ার হোসেন আশিক সিদ্ধিরগঞ্জ থানা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক। বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও তিনি নূর হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সরকারের আমলে হামলা-মামলা থেকে বাঁচতে নূর হোসেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেন তিনি। তার বিরুদ্ধেও এক ডজন মামলা রয়েছে।

মামলার ষষ্ঠ আসামি ইকবাল হোসেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তবে ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নজরুল ইসলামের সঙ্গে প্রতিদ্ধন্ধিতা করেন ইকবাল হোসেনও। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় নজরুলের মনোনয়ন বাতিলের জন্য বিভিন্ন মামলার কাগজপত্র নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেন ইকবাল। আপিল করে নজরুল তার মনোনয়নপত্র বৈধ করান।

ওই নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজরুলকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তিনি ছাড়া পান এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। হেনস্তা করার জন্য তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন নজরুল।

নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড, খন্দকার মহিদ উদ্দিন আগেই বলেছিলেন, তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে আপনারা সেটা প্রমান দেখেছেন। এজাহার ভুক্ত আসামী গ্রেফতার এবং তাদের বিদেশ পাড়ি দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, দেখুন আমরা দিন রাত কাজ করছি তবে তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তদন্ত একটি শৈল্পিক কাজ তাড়াহুড়া করে বৈপ্লবিক কোন ফল দেয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত কাজ করে যাচ্ছি।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠা ছয়জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পরদিন ১মে আরও একজনের লাশ পাওয়া যায় নদীতে। অপহরণের পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়।

সাত খুনের দুটি মামলায় এ পর্যন্ত র‌্যাবের ১৭ জন সদস্যসহ মোট ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপহরণ ও হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২১জন আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। এ ছাড়াও ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ইতোমধ্যে ১৬ জন আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here