তসলিমা নাসরিন তসলিমা নাসরিন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আজ বৃহস্পতিবার যে স্ট্যাটাসটি  দিয়েছেন, এখানে তা হুবহু তুলে দেওয়া হলো :

তসলিমা নাসরিন :: নিউইয়র্কে অসুস্থ ভাই পড়ে আছে। বোনটা তার দেখাশোনা করছে। বোনটা অমানুষিক পরিশ্রম করে। কুড়ি বছর বিদেশে বাস করার পর বলে, দেশেই ভালো ছিল। মানুষ সোনার হরিণের আশায় দেশ ছাড়ে।

আমার বোনটা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, আমার বোন হওয়ার অপরাধে ওর দেশে কোথাও কোনও চাকরি জুটছিল না বলে, দেশে ওকে হুমকি দিচ্ছিল ধর্মের রক্ষকরা। কুড়ি বছর চলে যাওয়ার পর ভুল শোধরানো যায় না।

মেয়ে বড় হয়ে গেছে। মেয়ে দেশে ফিরতে চায় না । মেয়ের টানে রয়ে যেতে হয়। আমার বোনই শুধু নয়, হাজারো অভিবাসীর প্রায় একই গল্প। বোনটাকে কোনও সান্ত্বনা আমি দিতে পারি না। জীবন আমাদের ফুরিয়ে যাচ্ছে।

কেবল কষ্টে, কেবল সংগ্রামে, কেবল হতাশায়। দুটো তিনটে জীবন হলে স্বস্তি পেতাম। কিন্তু একটাই জীবন। এই একটা জীবনই কাটাতে হচ্ছে জীবনের কোনও রূপ রস গন্ধ আস্বাদন করা ছাড়াই। কে বলে কর্মফল মানুষ এই জগতেই ভোগ করে! স্বর্গ নরক এই জগতেই! মিথ্যে কথা। বেশির ভাগ অসৎ, ধর্ষক, ঠগবাজ, দূর্নীতিবাজ, খুনী স্বর্গসুখে আছে। যারা সৎ, কর্মঠ, উদার– তাদের বেশির ভাগই ভোগে নরকের যন্ত্রণায়, অভাবে, আর নিরাপত্তহীনতায়।

বোনের সঙ্গে ইচ্ছে হয় প্রতিদিন কথা বলি। কিন্তু বোন বলে, তার সময় নেই কথা বলার। মন খারাপ হয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনহীন জীবন আমি যাপন করছি আজ কুড়ি বছরেরও বেশি। বোনটা তো আমার মায়ের মতো উদার। ও কেন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পায় না! অভিমান হয়।

আবার ভাবি, সময় পাবেই বা কী করে! দু’দণ্ড সময় ওর নিজের জন্যই নেই। একটি পুরুষতান্ত্রিক পরিবার তো বাংলাদেশ থেকে মানুষ বহন করে নিয়ে যায় বিদেশে, যে পরিবারে গাধার খাটুনি খাটতে হয় মেয়েদের। দেশে থাকলে অন্তত সাহায্য করার কাউকে জুটতো। ওখানে কেউ নেই। স্বামী কাজ করবে, ঘরে ফিরে টিভি দেখবে। স্ত্রী বাইরে কাজ করবে, ঘরে ফিরে ঘরদোর পয়-পরিস্কার করবে, কাটাবাছা করবে, রান্না করবে, বাসন ধোবে, লণ্ড্রী করবে, বাজার করবে, বাচ্চা লালন পালন করবে, বাচ্চা কুকুরবেড়াল রাখতে চায়, সুতরাং কুকুর বেড়ালের লালন পালনের ভারও স্ত্রীর ওপর।

আমার বোনটা স্ত্রীর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে। আরও একটি দায়িত্ব পালন করছে, সেটি হলো স্বামীর চিৎকার চেঁচামেচি দুর্ব্যবহার সওয়ার দায়িত্ব। হাজারো মেয়ের তো একই গল্প।

মাঝে মাঝে ভালো লাগে ভাবতে যে, আমার গল্প ওরকম নয়। আমার গল্পে দুঃখ আছে, কিন্তু দুঃখটা অন্যরকম। পুরুষতন্ত্রের অত্যাচার আমাকে বাইরে সইতে হয়, ঘরে নয়। ঘরটাকে পুরুষমুক্ত রেখেছি। আছি আমি আর আমার বেড়াল। আমার বেড়ালটা মেয়ে বেড়াল।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here